পরিস্থিতির উন্নতি ॥ সংখ্যালঘুদের মাঝে চাপা ভীতি
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৌদ্ধ বিহার ও মন্দির, বসতবাড়িতে হামলা ভাংচুর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর ভীতিকর পরিবেশ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলেও চাপা ভয়ভীতি অব্যাহত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা নতুন করে বাঁচার আশায় মন বাঁধছে। যদিও এখনও ক্ষতবিক্ষত বিহার, মন্দির ও বাড়িঘরগুলো খাঁ খাঁ করছে। এ অবস্থায় আগামী ৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামুর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে আসছেন। উখিয়া এবং টেকনাফে যাবেন কি না, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অপরদিকে, বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে দলের সংসদীয় একটি টিম আজ শুক্রবার কক্সবাজার আসছেন। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করবেন বলে দলীয় সূত্রে জানানো হয়েছে। সর্বশেষ টেকনাফের সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহ থেকে ১৪৪ ধারা তুলে নেয়া হয়েছে। এর আগে রামু থেকে এ ধারা তুলে নেয়া হয়, উখিয়াতে করা হয় শিথিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের এ ঘটনা নিয়ে আগাম তথ্য বের করে আনতে চরম ব্যর্থতা এবং ঘটনা চলাকালে প্রশাসনের চরম অবহেলা নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে সবার মাঝে। এত বড় একটি ঘটনার পর এ পর্যন্ত শুধু রামু থানার ওসিকে প্রত্যাহার করে দেখানো হয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথিত নিদর্শন। যা উল্টো জনমনে হাসির খোরাক যুগিয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে ওপর মহলকে কী জানানো হচ্ছে তা গোপন থাকলেও একথা সবার মনে স্থির বিশ্বাসই এসেছে যে, নৃশংস এসব ঘটনার পর এ পর্যন্ত মূল হোতাদের কাউকে আইনের আওতায় এখনও আনা যায়নি। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হোতাদের মুখোশ কিছু কিছু উন্মোচন করে যাচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকা।
সংখ্যালঘু দুই সম্প্রদায়ের বাড়িঘর বিহার ও মন্দিরে নৃশংস এ ঘটনার পর গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পটিয়ায় ২৬ জনকে রিমান্ডে আনার পর ৭ জনকে প্রথম পর্বে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু“হয়েছে। টেকনাফে পুলিশ ২৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদিন, উখিয়াতে আটককৃত ৪১ জন এবং রামুতে ১১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর রামু, উখিয়া, টেকনাফ এবং কক্সবাজারে মৌলবাদী বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহ নিরাপত্তার স্বার্থে কক্সবাজার বড়ুয়া ও রাখাইন পল্লী এবং রামু, উখিয়া এবং টেকনাফে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সেনা, র্যাব, বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
এদিকে, সরকারী তদন্ত দলের কাজ চলছে। এছাড়া ঢাকা থেকে আগত সিআইডির একটি টিম রামু এলাকায় গিয়ে নমূনা সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখবেন ঘরবাড়ি, মন্দির, বিহার পোড়ানোর কাজে পেট্রোল ও গান পাউডার ব্যবহার হয়েছিল কিনা।
রামুতে প্রান্তিক ফিলিং স্টেশন থেকে পেট্রোল নেয়ার যে ঘটনা বেরিয়ে এসেছে পুলিশ এ নিয়ে ফিলিং স্টেশন মালিককে খুঁজছে। ঘটনার ৫ দিনের মাথায়ও পুলিশ সুনির্দিষ্টভাবে মূল হোতাদের চিহ্নিত করতে না পারায় সর্বত্র নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। যা সরকারবিরোধী সেন্টিমেন্ট হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। রামুতে ভয়াবহ হামলার পূর্বে বাজার এলাকায় যে সমাবেশ হয়েছিল তাতে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের লোকজনের পাশাপাশি ইউএনও হাজির ছিলেন। উত্তেজিতদের প্রশমিত করতে এ সমাবেশ করা হয় বলে দাবি রয়েছে। সমাবেশে উত্তেজিতদের সঙ্গে ‘আপনাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করলাম’Ñ একথা বলেছিলেন এলাকার বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল। ঐদিন অর্থাৎ শনিবার রাত চৌমুহনী, ম-লপাড়া, ফকিরাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় কারা উস্কানিমূলক মিছিল করেছে তা এলাকাবাসীর কাছে চিহ্নিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মুখে ৩০টিরও বেশি মোটরসাইকেলযোগে একশ্রেণীর উচ্ছৃঙ্খল যুবক গান পাউডার, পেট্রোল ও কেরোসিন সরবরাহ করেছে উত্তেজিতদের কাছে। এ ধরনের জিনিসপত্র নিয়ে আগুন দেয়ার ঘটনায় জড়িত ৪০ জনের নাম পেয়েছে স্থানীয় পুলিশ।
টেকনাফ পরিস্থিতি
টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং জোয়ারিয়া খোলায় সহিংসতার পর দুই মামলায় ৬৫৩ জনকে আসামি করা হয়। ঐসব মামলায় জেলা জামায়াতের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারীকে করা হয়েছে প্রধান আসামি। এখানে চারদিনে আটক হয়েছে ৩১। মূল আসামি নুর আহমদ আনোয়ারীকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। এদের মধ্যে ২৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। স্থানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ সরবরাহ করেছে।
পটিয়া ॥ বৌদ্ধ বিহার ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ভাংচুর করে অগ্নিসংযোগ করার ঘটনায় চট্টগ্রামের পটিয়া থানা পুলিশ গ্রেফতারকৃত ২৬ আসামিকে রিমান্ডে আনার পর এদের মধ্যে ৭ আসামিকে রিমান্ডে আনলেও তারা মুখ খুলছে না। বুধবার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের পর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। আসামিরা হলেন, দেশের বৃহৎ জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিনের শ্রমিক লাখেরা গ্রামের আবদুল মতিনের পুত্র মহিউদ্দিন (২১), কোলাগাঁও গ্রামের নুরুন্নবী পুত্র ইমরান (২১), শিকলবাহা গ্রামের আবদুল গফুরের পুত্র আবুল কাসেম (২৩), লাখেরা গ্রামের মহিউদ্দিনের পুত্র রুবেল (২৫), লাখেরা গ্রামের মোহাম্মদ আলীর পুত্র ইব্রাহিম (২১), কোলাগাঁও গ্রামের আবদুল মন্নানের এরশাদ (২৮), কোলাগাঁও গ্রামের মতিউর রহমানের পুত্র আবদুর রহমান (২১)। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) নাজমুল হাসানের তত্ত্বাবধানে এদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এদিকে, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিহার ও শত বছরের পুরনো বৌদ্ধ মূর্তি ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে আজ শুক্রবার পটিয়া থানার মোড়ে সম্মলিত বৌদ্ধ সমাজ পরিষদের উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হবে।
পুলিশ জানায়, রবিবার উপজেলার কোলাগাঁও গ্রামে বৌদ্ধ বিহার ও মন্দির ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনায় পুলিশ ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে চিহ্নিত করে ৩২ জনকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় পৃথক ৩টি মামলা হয়। উক্ত আসামিদের পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করলে বুধবার চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবু সালেম মোঃ নোমান দুই মামলায় তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তার মধ্যে রতœাঙ্কুর বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ দিবানন্দ ভিক্ষুর দায়েরকৃত মামলায় ২ দিন এবং পুলিশের ২টি মামলায় ১ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রথম দফায় বুধবার রাতে পুলিশ আসামিদের মধ্যে থেকে ৭ জনকে পটিয়া থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে।
পটিয়া থানার ওসি আমিনুর রশিদ রিমান্ডের প্রথম দিন শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রিমান্ডের আসামিদের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের কাছ থেকে কিছু তথ্যও পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। কারাগারে থাকা অন্যান্য আসামিদেরও পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার ইন্ধনদাতাসহ প্রকৃত ক্লু বের করা সম্ভব হবে। বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান। তিনি বর্তমানে পটিয়ার ৩৯টি বৌদ্ধ বিহার ও দুই শতাধিক মন্দিরে নিরাপত্তায় কমিটি গঠন করা হয়েছে।
উখিয়া
রামুতে পবিত্র কোরান অবমাননাকর ছবি ফেসবুকে প্রদর্শিত হওয়ার ঘটনায় উখিয়ার বিভিন্ন স্থানের অবস্থিত বৌদ্ধ বিহার, মন্দিরে অগ্নিকা-, ভাংচুর, লুটপাট ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় ৪টি মামলায় পুলিশ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪১ জনকে আটক করেছে। আটককৃতদের ১ দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। উপজেলার পালংখালী গয়ালমারা ভুবনশ্বরী কালী মন্দির ভাংচুর, মন্দিরের পার্শ্ববর্তী ধনু রাম শীলের ঘরে আগুন ও সতীশ শর্মা, রীনা শর্মা, বজেন্দ্র শর্মাসহ ৫ বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়ি ভাংচুর, তাদের মারধর, লুটপাট চালানোর অভিযোগে ১৩ জনকে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাতনামা দেড়-দুই হাজার জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। মরিচ্যা বৌদ্ধ বিহারে অগ্নিসংযোগ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ৫টি বসতবাড়ি ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ২৬ জনকে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাতনামা দেড় হাজার, জাদিমুরা বৌদ্ধ বিহারে ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ৭ জনকে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাতনামা দেড়-২শ’ ও কোটবাজার বৌদ্ধ বিহারে ভাংচুর অগ্নিসংযোগ ও পুলিশ এসব মামলায় ২৮ জনকে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাতনামা দুই হাজার জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করা হয়। উপজেলার খয়রাতি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে উপজেলা প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে ১৪৪ ধারা জারি করেছে যা এখনও বলবৎ রয়েছে। স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েনসহ র্যাব, পুলিশ, বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। উখিয়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনও আতঙ্ক কাটেনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জহিরুল ইসলাম জানান, উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করার পর থেকে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হতে শুরু করেছে। র্যাব, বিজিবি ও পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে টহল অব্যাহত রেখেছে।
আলামত সংগ্রহ
এদিকে রামু উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্ব বৃহৎ সিংহশয্যা গৌতম বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসে ব্যবহৃত হাতবোমা (ককটেল)সহ ধ্বংসযজ্ঞে ব্যবহৃত বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে বিশেষজ্ঞ দফতরে পাঠানো হয়েছে। গত শনিবার রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার লোমহর্ষক ভিডিও ফুটেজ ও স্থির ছবি সংগ্রহ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
রামুর উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত দেশের বৃহত্তম একশ ফুট সিংহ শয্যা গৌতম বুদ্ধমূর্তির অবকাঠামোর ভিতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৭টি বিষ্ফোরিত হাতবোমা (ককটেল)-এর খোসা। বুদ্ধমূর্তির প্রতিষ্ঠাতা কর নাশ্রী থের জানান, ২৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর বুধবার বুদ্ধমুর্তির শরীরে ফাটল দেখলে তিনি স্থানীয় লোকজন নিয়ে বিজিবি জওয়ানদের উপস্থিতিতে ফাটল হওয়া বুদ্ধমূর্তির অবকাঠামোর ভেতরে প্রবেশ করে একে একে ৭টি বিস্ফোরিত হাতবোমা (ককটেল)-এর খোসা দেখতে পান। করুনাশ্রী ভিক্ষু জনকণ্ঠকে জানান, ওই দিন পুলিশের তদন্তদল ও বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি অশোক বড়ুয়া বিস্ফোরিত হাতবোমা (ককটেল)-এর একটি খোসা নিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার সিআইডির এএসপি হ্লাচিংপ্র মারমার নেতৃত্বে তদন্ত দল বিস্ফোরিত হাতবোমা (ককটেল)-এর একটি খোসা পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছে।
সংখ্যালঘু দুই সম্প্রদায়ের বাড়িঘর বিহার ও মন্দিরে নৃশংস এ ঘটনার পর গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পটিয়ায় ২৬ জনকে রিমান্ডে আনার পর ৭ জনকে প্রথম পর্বে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু“হয়েছে। টেকনাফে পুলিশ ২৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদিন, উখিয়াতে আটককৃত ৪১ জন এবং রামুতে ১১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর রামু, উখিয়া, টেকনাফ এবং কক্সবাজারে মৌলবাদী বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহ নিরাপত্তার স্বার্থে কক্সবাজার বড়ুয়া ও রাখাইন পল্লী এবং রামু, উখিয়া এবং টেকনাফে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সেনা, র্যাব, বিজিবি ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
এদিকে, সরকারী তদন্ত দলের কাজ চলছে। এছাড়া ঢাকা থেকে আগত সিআইডির একটি টিম রামু এলাকায় গিয়ে নমূনা সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখবেন ঘরবাড়ি, মন্দির, বিহার পোড়ানোর কাজে পেট্রোল ও গান পাউডার ব্যবহার হয়েছিল কিনা।
রামুতে প্রান্তিক ফিলিং স্টেশন থেকে পেট্রোল নেয়ার যে ঘটনা বেরিয়ে এসেছে পুলিশ এ নিয়ে ফিলিং স্টেশন মালিককে খুঁজছে। ঘটনার ৫ দিনের মাথায়ও পুলিশ সুনির্দিষ্টভাবে মূল হোতাদের চিহ্নিত করতে না পারায় সর্বত্র নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। যা সরকারবিরোধী সেন্টিমেন্ট হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। রামুতে ভয়াবহ হামলার পূর্বে বাজার এলাকায় যে সমাবেশ হয়েছিল তাতে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের লোকজনের পাশাপাশি ইউএনও হাজির ছিলেন। উত্তেজিতদের প্রশমিত করতে এ সমাবেশ করা হয় বলে দাবি রয়েছে। সমাবেশে উত্তেজিতদের সঙ্গে ‘আপনাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করলাম’Ñ একথা বলেছিলেন এলাকার বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল। ঐদিন অর্থাৎ শনিবার রাত চৌমুহনী, ম-লপাড়া, ফকিরাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় কারা উস্কানিমূলক মিছিল করেছে তা এলাকাবাসীর কাছে চিহ্নিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মুখে ৩০টিরও বেশি মোটরসাইকেলযোগে একশ্রেণীর উচ্ছৃঙ্খল যুবক গান পাউডার, পেট্রোল ও কেরোসিন সরবরাহ করেছে উত্তেজিতদের কাছে। এ ধরনের জিনিসপত্র নিয়ে আগুন দেয়ার ঘটনায় জড়িত ৪০ জনের নাম পেয়েছে স্থানীয় পুলিশ।
টেকনাফ পরিস্থিতি
টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং জোয়ারিয়া খোলায় সহিংসতার পর দুই মামলায় ৬৫৩ জনকে আসামি করা হয়। ঐসব মামলায় জেলা জামায়াতের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারীকে করা হয়েছে প্রধান আসামি। এখানে চারদিনে আটক হয়েছে ৩১। মূল আসামি নুর আহমদ আনোয়ারীকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। এদের মধ্যে ২৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। স্থানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ সরবরাহ করেছে।
পটিয়া ॥ বৌদ্ধ বিহার ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ভাংচুর করে অগ্নিসংযোগ করার ঘটনায় চট্টগ্রামের পটিয়া থানা পুলিশ গ্রেফতারকৃত ২৬ আসামিকে রিমান্ডে আনার পর এদের মধ্যে ৭ আসামিকে রিমান্ডে আনলেও তারা মুখ খুলছে না। বুধবার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের পর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। আসামিরা হলেন, দেশের বৃহৎ জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিনের শ্রমিক লাখেরা গ্রামের আবদুল মতিনের পুত্র মহিউদ্দিন (২১), কোলাগাঁও গ্রামের নুরুন্নবী পুত্র ইমরান (২১), শিকলবাহা গ্রামের আবদুল গফুরের পুত্র আবুল কাসেম (২৩), লাখেরা গ্রামের মহিউদ্দিনের পুত্র রুবেল (২৫), লাখেরা গ্রামের মোহাম্মদ আলীর পুত্র ইব্রাহিম (২১), কোলাগাঁও গ্রামের আবদুল মন্নানের এরশাদ (২৮), কোলাগাঁও গ্রামের মতিউর রহমানের পুত্র আবদুর রহমান (২১)। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) নাজমুল হাসানের তত্ত্বাবধানে এদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এদিকে, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিহার ও শত বছরের পুরনো বৌদ্ধ মূর্তি ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে আজ শুক্রবার পটিয়া থানার মোড়ে সম্মলিত বৌদ্ধ সমাজ পরিষদের উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হবে।
পুলিশ জানায়, রবিবার উপজেলার কোলাগাঁও গ্রামে বৌদ্ধ বিহার ও মন্দির ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনায় পুলিশ ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে চিহ্নিত করে ৩২ জনকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় পৃথক ৩টি মামলা হয়। উক্ত আসামিদের পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করলে বুধবার চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবু সালেম মোঃ নোমান দুই মামলায় তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তার মধ্যে রতœাঙ্কুর বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ দিবানন্দ ভিক্ষুর দায়েরকৃত মামলায় ২ দিন এবং পুলিশের ২টি মামলায় ১ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রথম দফায় বুধবার রাতে পুলিশ আসামিদের মধ্যে থেকে ৭ জনকে পটিয়া থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে।
পটিয়া থানার ওসি আমিনুর রশিদ রিমান্ডের প্রথম দিন শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রিমান্ডের আসামিদের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের কাছ থেকে কিছু তথ্যও পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। কারাগারে থাকা অন্যান্য আসামিদেরও পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার ইন্ধনদাতাসহ প্রকৃত ক্লু বের করা সম্ভব হবে। বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান। তিনি বর্তমানে পটিয়ার ৩৯টি বৌদ্ধ বিহার ও দুই শতাধিক মন্দিরে নিরাপত্তায় কমিটি গঠন করা হয়েছে।
উখিয়া
রামুতে পবিত্র কোরান অবমাননাকর ছবি ফেসবুকে প্রদর্শিত হওয়ার ঘটনায় উখিয়ার বিভিন্ন স্থানের অবস্থিত বৌদ্ধ বিহার, মন্দিরে অগ্নিকা-, ভাংচুর, লুটপাট ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় ৪টি মামলায় পুলিশ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪১ জনকে আটক করেছে। আটককৃতদের ১ দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। উপজেলার পালংখালী গয়ালমারা ভুবনশ্বরী কালী মন্দির ভাংচুর, মন্দিরের পার্শ্ববর্তী ধনু রাম শীলের ঘরে আগুন ও সতীশ শর্মা, রীনা শর্মা, বজেন্দ্র শর্মাসহ ৫ বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়ি ভাংচুর, তাদের মারধর, লুটপাট চালানোর অভিযোগে ১৩ জনকে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাতনামা দেড়-দুই হাজার জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। মরিচ্যা বৌদ্ধ বিহারে অগ্নিসংযোগ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ৫টি বসতবাড়ি ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ২৬ জনকে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাতনামা দেড় হাজার, জাদিমুরা বৌদ্ধ বিহারে ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ৭ জনকে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাতনামা দেড়-২শ’ ও কোটবাজার বৌদ্ধ বিহারে ভাংচুর অগ্নিসংযোগ ও পুলিশ এসব মামলায় ২৮ জনকে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাতনামা দুই হাজার জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করা হয়। উপজেলার খয়রাতি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে উপজেলা প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে ১৪৪ ধারা জারি করেছে যা এখনও বলবৎ রয়েছে। স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েনসহ র্যাব, পুলিশ, বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। উখিয়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনও আতঙ্ক কাটেনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জহিরুল ইসলাম জানান, উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করার পর থেকে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হতে শুরু করেছে। র্যাব, বিজিবি ও পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে টহল অব্যাহত রেখেছে।
আলামত সংগ্রহ
এদিকে রামু উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্ব বৃহৎ সিংহশয্যা গৌতম বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসে ব্যবহৃত হাতবোমা (ককটেল)সহ ধ্বংসযজ্ঞে ব্যবহৃত বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে বিশেষজ্ঞ দফতরে পাঠানো হয়েছে। গত শনিবার রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার লোমহর্ষক ভিডিও ফুটেজ ও স্থির ছবি সংগ্রহ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
রামুর উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত দেশের বৃহত্তম একশ ফুট সিংহ শয্যা গৌতম বুদ্ধমূর্তির অবকাঠামোর ভিতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৭টি বিষ্ফোরিত হাতবোমা (ককটেল)-এর খোসা। বুদ্ধমূর্তির প্রতিষ্ঠাতা কর নাশ্রী থের জানান, ২৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর বুধবার বুদ্ধমুর্তির শরীরে ফাটল দেখলে তিনি স্থানীয় লোকজন নিয়ে বিজিবি জওয়ানদের উপস্থিতিতে ফাটল হওয়া বুদ্ধমূর্তির অবকাঠামোর ভেতরে প্রবেশ করে একে একে ৭টি বিস্ফোরিত হাতবোমা (ককটেল)-এর খোসা দেখতে পান। করুনাশ্রী ভিক্ষু জনকণ্ঠকে জানান, ওই দিন পুলিশের তদন্তদল ও বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি অশোক বড়ুয়া বিস্ফোরিত হাতবোমা (ককটেল)-এর একটি খোসা নিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার সিআইডির এএসপি হ্লাচিংপ্র মারমার নেতৃত্বে তদন্ত দল বিস্ফোরিত হাতবোমা (ককটেল)-এর একটি খোসা পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছে।
No comments:
Post a Comment