Tuesday 16 October 2012


Prothom Alo

ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ অক্টোবর ২০১২, ১ কার্তিক ১৪১৯, ২৯ জিলকদ ১৪৩৩সহজিয়া কড়চা

রোরুদ্যমান রামু

সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ১৬-১০-২০১২
কক্সবাজার থেকে রামুর দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। গাড়িতে মিনিট বিশেকের পথ। শহরের বৌদ্ধমন্দির সড়কে ঢুকেই ডান দিকে তাকিয়ে দেখি, কয়েকটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বৌদ্ধবিহার। মন্দির প্রাঙ্গণে ফল-ফুলের গাছ পুড়ে ছাই। অতি উঁচু নারকেল-সুপারির গাছগুলোও পুড়ে কয়লায় পরিণত হয়েছে। মনে হলো রামু কাঁদছে। রোরুদ্যমান রামু। জাগতিক নিয়মে মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। শুধু নীরবে কাঁদছে দেশের এক প্রান্তে পড়ে থাকা কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন শান্তিপূর্ণ শহরটি। 
ধারণা করা যায় না যে এ কোনো মানুষের কাজ। মনে হলো, যেন এক ক্রুদ্ধ অপদেবতা ভয়ংকর আক্রোশবশত সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে। প্রধানত কাঠ ও টিনের তৈরি মন্দির আগুনে পুড়ে মিশে গেছে মাটিতে। কংক্রিটের মেঝে ও মাটির ভিটেটাই শুধু পুড়তে পারেনি। মন্দির চত্বরের বিচিত্র ফুলগাছগুলো পুড়ে ছাই। ফলমূলের গাছগুলোর আছে শুধু কঙ্কাল। আম-কাঁঠালগাছগুলো হয়ে গেছে কাঠকয়লা। প্রাচীন লালচিং বৌদ্ধবিহারের অতি উঁচু নারকেল-সুপারির গাছগুলোর পাতা বলে কিছু নেই। আমার অতি স্নেহভাজন রোবায়েত ফেরদৌস কথা না বলে বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারেন না। শহরে প্রবেশের পর অনেকক্ষণ নির্বাক থেকে তিনি একটি উঁচু নারকেলগাছ দেখিয়ে বললেন, ‘মকসুদ ভাই, দ্যাখেন, কচি ডাবগুলো আগুনে ঝলসে শুকনা নারকেলের মতো হয়ে গেছে।’ অপলক দৃষ্টিতে আমি দেখছিলাম পুড়ে যাওয়া এক বোধিবৃক্ষ। 
বিধ্বস্ত বিহারগুলোর ফটকে পাহারা দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। যদিও এখন তার আর কোনো প্রয়োজন নেই। পাহারার প্রয়োজন ছিল গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে। তখন রামুর ত্রিসীমানায় কাউকে পাওয়া যায়নি। 
১৯৪৬-এর অক্টোবরে নোয়াখালীতে হিন্দুবিরোধী দাঙ্গার পরে রামুর বৌদ্ধবিরোধী এই ঘটনা এ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক। উন্মত্ত জনতার হাতে বিধ্বস্ত হয়েছে বৌদ্ধ উপাসনালয় বিহার এবং বৌদ্ধদেব বসতবাড়ি। এই সময় ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সান্ত্বনা ও সহানুভূতির, তখন শাসকশ্রেণীর নেতারা লিপ্ত অসুন্দর বাক্য-প্রতিযোগিতায়। নারকীয় ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে দুই সপ্তাহ ধরে চলছে পারস্পরিক দোষারোপ। বিশ্রী বাক্যবিনিময়। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি টিভির পর্দা থেকে নির্গত হচ্ছে বিষ। একটি চরম দুঃখের মুহূর্তে প্রতিপক্ষকে দোষারোপের এমন দৃষ্টান্ত মানবজাতির ইতিহাসে আর কোনো দেশে আছে কি না, আমার জানা নেই। 
রামুর চরম ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধদের যে বোধ ও বিবেক রয়েছে, আমাদের নেতাদের তা নেই। রামুর ক্ষতিগ্রস্ত কেন্দ্রীয় সীমাবিহারের শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু ‘সেই বিভীষিকাময় রাত’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আমরা শোকাহত-মর্মাহত কিন্তু এখনো আশাহত হইনি। আমরা সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে এই দেশে বাঁচতে চাই। যা ঘটার, তা ঘটে গেছে। আমরা যা হারানোর, তা হারিয়েছি। নতুন করে হারানোর আর কিছুই নেই প্রাণ ছাড়া। ঘটনার পর এখন যা দেখা যাচ্ছে, তা আমাদের কাম্য নয়। এটিকে রাজনৈতিক ইস্যু করে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কাদা-ছোড়াছুড়ি হোক, তা আমরা মোটেই কামনা করি না। আলোচনায় আসছে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও রোহিঙ্গা ইস্যু। প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার শিকার হিসেবে আমি বলব, রামুর এই সহিংস ঘটনার জন্য কোনো নির্দিষ্ট একটি দল বা গোষ্ঠীকে দায়ী করা ঠিক হবে না। তদন্ত হওয়ার আগে থেকেই পারস্পরিক দোষারোপ চলতে থাকলে ঘটনার প্রকৃত রহস্য চাপা পড়ে যাবে, প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। তা হলে এ ধরনের [আরও] সহিংস ও সাম্প্রদায়িক অপরাধ রোধ করা যাবে না।’ [প্রথম আলো, ১০ অক্টোবর ২০১২]
সরকার তার প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য বিন্দুমাত্র বিব্রত বা লজ্জিত নয়। কর্তব্যে অবহেলা হোক বা ভুল হোক—তা স্বীকার করা নিজেকে নিজে দোষী সাব্যস্ত করা নয়। প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু আরও লিখেছেন, ‘রামুর যেখানে জ্বালাও-পোড়াও ঘটেছে, তা দুর্গম এলাকা নয়। থানা-পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় অবস্থিত রামুর এসব বৌদ্ধবিহার ও পল্লি। ঘটনার ইঙ্গিত ও আশঙ্কা সন্ধ্যা থেকেই বিরাজ করছিল। প্রশাসন স্বয়ং তা প্রত্যক্ষ করেছে। জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট ও ভাঙচুর হয়েছে রাত প্রায় ১২টার পর। রামুর শ্রীকুল গ্রামের লালচিং সাদাচিং, মৈত্রী বিহার, অপর্ণাচরণ মন্দিরে রাত ১২টায় আগুন দিলেও রামু সীমাবিহারে আগুন দিয়েছে রাত একটার পর। রামু উত্তর মিঠাছড়ি ভাবনা কেন্দ্রে রাত আড়াইটা-তিনটার দিকে এবং প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারে আগুন দিয়েছে ভোররাত চারটার দিকে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সবখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাজির হয়েছে পুড়ে যাওয়ার পর। স্থানীয় প্রশাসনকে বারবার বলা হলেও তারা কোনো গুরুত্ব দেয়নি।’
রামু-উখিয়ার ঘটনার পরপরই আমাদের পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো তাদের সাধ্যমতো ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন তুলে ধরেছে। ঘটনার নিন্দা করে নিবন্ধ লিখেছেন অনেকে। আবেগ ও সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে সব লেখায়। সংখ্যালঘুসংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশে প্রতিবাদের যে প্রথাগত ভাষা, সেই ভাষায়ই এ ঘটনারও নিন্দা হয়েছে। বহু প্রতিনিধিদল সফর করেছে ঘটনাস্থল। সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, আলোচনা সভা হয়েছে সারা দেশে। কোনো নির্ভরযোগ্য অনুসন্ধান ছাড়াই অনুমান করা হচ্ছে, ঘটনাটির জন্য মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠী ও রোহিঙ্গারা দায়ী। 
উপমহাদেশে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার দুটি ধারা। একটি ধর্মীয় অন্ধতা ও গোঁড়ামিবশত। তার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যটি ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতিপ্রসূত। অন্ধ ও গোঁড়া মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি উসকে দিয়ে খেপিয়ে তোলা খুব সহজ। সেই সুযোগটি নেন ইসলামি মৌলবাদী রাজনীতির নেতারা। যে এলাকায় ঘটনা ঘটেছে, সেই কক্সবাজার জেলার রামু ও উখিয়ার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস কয়েক শতাব্দীর। এখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, বাঙালি, রাখাইন প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষ সৌভ্রাতৃত্বের মধ্যে বসবাস করছেন শত শত বছর যাবৎ। সাম্প্রতিক কালে জমি দখলের লোভে সংঘটিত দু-চারটি ঘটনা ছাড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোনো দৃষ্টান্ত কক্সবাজার জেলার কোথাও নেই। রামু-উখিয়ার ঘটনায় যারা অংশ নিয়েছে, তারা সবাই মুসলমান। সংবাদে জানা গেছে, দুষ্কৃতকারী উচ্ছৃঙ্খল জনতার মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরও দেখা গেছে। 
ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধধর্মীয় নেতাদের বক্তব্য, ‘প্রশাসনিক তদন্তে আমাদের কোনো আস্থা নেই।...রামুর এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কয়েকটি বিহার রক্ষা পেয়েছে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানবতাবাদী লোকের প্রচেষ্টায়। এ কাজে প্রশাসন কোনো কাজে লাগেনি।’ প্রশাসন ও সরকারি দলের নেতাদের ভূমিকা এখন জনগণের কাছে স্পষ্ট। 
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকাটা কী? তাদের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ঘুরে এসে তারা একটি ‘তদন্ত প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, ‘আগামী সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকারের মদদে পরিকল্পিতভাবে এ হামলা করা হয়েছে।’ তারা কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থিত করেনি। বিএনপির প্রতিবেদনকে একটি তৃতীয় শ্রেণীর খবরের কাগুজে রচনা ছাড়া আর কিছু মনে করা সম্ভব নয়। এর কোনো তথ্যগত ও তত্ত্বগত মূল্য নেই। কাঁচা রাজনীতির এক নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। ওই তদন্ত প্রতিবেদন মুসাবিদা করতে দলের বড় বড় নেতার ঢালঢোল পিটিয়ে সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সংবাদপত্র পাঠ করে এবং ঘরে বসে টিভি চ্যানেল দেখেই ঘণ্টা খানেকের মধ্যে এ-জাতীয় রচনা লেখা সম্ভব। ওই প্রতিবেদন একটি নিম্নমানের রাজনৈতিক রচনা। প্রধান বিরোধী দল তার রাজনৈতিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। 
এই সহিংসতার পেছনে স্থানীয় বিএনপিদলীয় এমপির সংশ্লিষ্টতার কথা বারবার বলছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই তাঁকে তথ্য-প্রমাণসহ এ সম্পর্কে জানিয়েছেন। যদি এমপি দোষ করে থাকেন, তাঁকে আইনের আওতায় আনতে হবে। কঠোর শাস্তি তাঁর প্রাপ্য। আর যদি তিনি দোষী না হন এবং তারপর যদি তাঁকে হয়রানি করা হয়, তা হলে এলাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাড়াবে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। সাধারণ মানুষ ও ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘুরা ঘটনার ‘প্রকৃত রহস্য’ ও সুষ্ঠু তদন্ত দেখতে চায়। যা ঘটেছে তার বাইরে নতুন কিছু যোগ হোক, তা তাদের একেবারেই কাম্য নয়। এমনিতেই তারা চরম অসহায় ও বিপন্ন বোধ করছে। 
মানুষ ঘটনাটি ঘটতে দেখেছে, কী ঘটেছে তা তাদের জানা, কিন্তু চক্রান্তটির গোড়া কোথায় তা জানে না। এমনকি হামলায় যারা অংশ নিয়েছে, যাদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ, তারাও জানে না পরিকল্পনাকারী কে বা কারা। তবে সে রাতের হামলাকারীদের অনেককেই রামুর মানুষ চেনে। তারা কেউ কেউ বড় বড় রাজনৈতিক দলের মানুষ। ভয়ে তাদের নাম কেউ বলতে চায় না। ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের অনেককে শনাক্ত করা সম্ভব, কিন্তু পরিকল্পনাকারীদের?
রামু-উখিয়ার ঘটনা কোনো সরল-সোজা দাঙ্গা-হাঙ্গামা নয়। হঠাৎ করে খেপে গিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে নিরীহ বাঙালিরা বৌদ্ধদের উপাসনালয় ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল, তা নয়। এ ঘটনার পরিকল্পনাকারীরা পাকা খেলোয়াড়। এটি একটি বহুমাত্রিক ব্যাপার। যাঁরা তদন্ত করবেন, তাঁদের স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় নিতে হবে। ঘটনাটি ঘটল কোথায়? ঘটল কোন সময়? অংশগ্রহণকারী কারা? আক্রমণের শিকার কারা? ঘটনার পারম্পর্য বিবেচনা না করে একে স্রেফ একটি সহিংস অপরাধ বা সাম্প্রদায়িক ঘটনা মনে করা ভুল হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যু ও সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের বিরোধ চলছে। মিয়ানমার সরকার ও বৌদ্ধদের দ্বারা নিপীড়িত মুসলমান রোহিঙ্গাদের সমস্যাটি এখন একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। সাম্প্রতিক কালেই তাদের ঘরবাড়ি-মসজিদ জ্বালানো হয়েছে। তাদের অনেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে এসেও আশ্রয় পায়নি। তাদের পুশব্যাক বা ফেরত পাঠানো হয়েছে। সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে মীমাংসা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও তাদের অনুগ্রহজীবীরা ওই রায়ের নামকরণ করল ‘সমুদ্র বিজয়’। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনো ভূখণ্ড বা পানিখণ্ড জয় করেনি। কিন্তু সেই বিজয় নিয়ে এমন লাফালাফি হলো, যা বালক-বালিকাদের শোভা পায়—কোনো সরকারের নয়। ঢাকার লাফালাফিতে ইয়াংগুনের বিরক্তির কারণ ঘটেছিল, তা পত্রিকার খবরে জানা গেছে।
রামুর ঘটনায় বিশেষভাবে ক্ষতি হয়েছে মহাজোট সরকারের এবং সাধারণভাবে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের। ঘটনার মাত্র দুই দিন আগে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার ইসলামি জঙ্গিদের কঠোর হাতে দমন করেছে। এই নারকীয়তা তাঁর বক্তব্যকে ভুল প্রমাণ করল। পৃথিবীর বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশের আন্তধর্মীয় সম্প্রীতির সুনাম রয়েছে। বৌদ্ধদের ওপর এই আক্রমণে প্রমাণিত হলো, সেই সুনাম বাংলাদেশের প্রাপ্য নয়। বাংলাদেশের সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রই বৌদ্ধসংখ্যাগরিষ্ঠ। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ক্যাম্পুচিয়া, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, চীন, ভুটান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চূর্ণ হয়ে গেল। ভারত ও নেপালের বৌদ্ধদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল দেখা দিল। এককথায় এই দুর্ঘটনায় প্রমাণিত হলো, বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে সংখ্যালঘু অমুসলমানরা নিরাপদ নয়।
বহু শ্রেণী-পেশার মানুষ রামু পরিদর্শনে গেছেন। পেশাজীবীদের প্রতিনিধিদল গেছে। আমাদের একটি পার্লামেন্ট রয়েছে। তার সদস্যরা ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধি। জনগণ তাঁদের কোটি কোটি টাকা দামের আরামদায়ক গাড়ির ব্যবস্থা করেছে। নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ করছে। ঠিক সময় টেলিফোনের বিল পরিশোধ না করলেও তাঁদের তাগাদা দেওয়া হয় বা লাইন কাটা হয় না, জনগণ তাড়া দেয় না। রাষ্ট্রের এমন আনুকূল্য নেই, যা তাঁরা ভোগ করেন না। রামুতে কোনো সর্বদলীয় সংসদীয় প্রতিনিধিদল গেছে—এমন খবর কোনো কাগজে পাইনি। বৌদ্ধদের ওপর আক্রমণ আমাদের মাননীয়দের মধ্যে কিছুমাত্র করুণার উদ্রেক করেনি। অথচ খুব বড় একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল স্পিকারের নেতৃত্বে ওখানে গিয়ে সপ্তাহ খানেক থাকলে অসহায় ও আতঙ্কিত সংখ্যালঘুরা অভয় পেত। এ ঘটনার পর জরুরি সংসদ অধিবেশন ডাকলে সংবিধান লঙ্ঘিত হতো না। 
আমরা একটি নাগরিক প্রতিনিধিদল রামু-উখিয়া পরিদর্শন করেছি। রামুর বিধ্বস্ত রাখাইন বড় ক্যাং, লালচিং, সাদাচিং, মৈত্রী বিহার, অপর্ণাচরণ মন্দির, সীমাবিহার এবং উখিয়ার খয়রাতিপাড়ায় প্রজ্ঞামিত্র বিহার ও পশ্চিম মরিচ্যায় দীপংকর বিহার পরিদর্শন করি। রামু শহরে যাঁদের বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলি। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, হামলাকারীদের অনেকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অসহায় কেউ কেউ বললেন, ‘আপনারা এসেছেন। আমরা বুকে একটু সাহস পাই।’ মনে মনে বললাম, আমরা তো তালপাতার সেপাই। কী ক্ষমতা আছে আমাদের? যাঁদের ক্ষমতা আছে, প্রতিপত্তি আছে, তাঁদের আজ দুর্গত ব্যক্তিদের পাশে থাকা দরকার।
প্রথাগত ভাষায় আমরা যতই বিচার বিভাগীয় তদন্তের কথা বলি—কোনো লাভ নেই। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে একটি সংসদীয় তদন্ত কমিটি করে সত্য খুঁজে বের করা এই মুহূর্তের দাবি। সেই কমিটিকে সহযোগিতা দিতে রাখা দরকার দক্ষ ও নিরপেক্ষ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক পদস্থ কর্মকর্তা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি। রামুর মর্মস্পর্শী ঘটনা জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টির একটি সুযোগ হতে পারে। 
টিন ও কাঠের তৈরি বিহার, বাড়িঘর ও গাছপালার ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপযোগ্য। একদিন নতুন বিহার ও বাড়িঘর নির্মিত হবে। বৌদ্ধরা বসবেন মন্দিরে প্রার্থনায় নতুন কোনো বৌদ্ধমূর্তির সামনে। পুনর্বাসিত হবেন গৃহহীন মানুষগুলো। কিন্তু অত পুরোনো কাঠ, পাথর ও ধাতুতে তৈরি বুদ্ধমূর্তি, তালপাতায় লেখা ত্রিপিটকের পবিত্র বাণী যা ধ্বংস হয়েছে, তা কোনো দিন পাওয়া যাবে না। ভাঙা বুদ্ধমূর্তিগুলো যেমন আর জোড়া লাগানো সম্ভব নয়, তেমনি ভাঙা মনও কি সহজে জোড়া লাগবে? তবু আমরা যে যে ধর্মের অনুসারীই হই না কেন, প্রার্থনা করি: জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments:

Post a Comment