Sunday 7 October 2012

রামুর ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি দিতে বাধা কোথায়?


রামুর ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি দিতে বাধা কোথায়?
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা
 আবু সাঈদ খান
রামু-টেকনাফ-উখিয়া-পটিয়ায় যারা বৌদ্ধ মন্দিরে বর্বরোচিত হামলা চালাল, অহিংস মানুষের হৃদয় রক্তাক্ত করল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণে কুঠার হানল, শত শত বছরের সভ্যতা ও ইতিহাসের অমূল্য নিদর্শন পুড়িয়ে দিল_ তারা কারা? তাদের পেছনেই-বা রয়েছে কারা? দেশের শান্তি ও সংহতি রক্ষায় হামলাকারী ও মদদদাতাদের চিহ্নিত করা দরকার। এ ঘটনার পেছনে ভোটব্যাংক রক্ষার রাজনীতি, রোহিঙ্গা ইস্যু, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গি কানেকশন, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ইত্যাদির মধ্যে কোনোটার বা একাধিক ঘটনার যোগসূত্র আছে কি-না তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। উদ্বেগের বিষয় হলো, এমন সাম্প্রদায়িক ও অমানবিক হামলার ঘটনা একের পর এক ঘটছে। সাতক্ষীরা, হাটহাজারী, রাঙামাটি প্রভৃতি স্থানে সংখ্যালঘু-আদিবাসীরা হামলার শিকার হচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার হচ্ছে না কেন? কেনই-বা আমরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মোকাবেলা করতে পারছি না?
রামুর প্রসঙ্গেই আসা যাক, সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী উত্তম কুমার বড়ূয়া নামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক যুবকের ফেসবুকে অন্য কেউ ইসলাম ধর্মের অবমাননাকর একটি ছবি সংযুক্ত করেছিল। এর প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় বক্তব্য রাখেন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা, এমনকি থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাও। এরপর শুরু হয় বৌদ্ধ মন্দিরমুখী মিছিল_ যে মিছিলের উন্মত্ত লোকেরা বৌদ্ধ জনপদ ও মন্দির ধ্বংসের জন্য দায়ী। বলাবাহুল্য, ফেসবুক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মাত্রই জানেন অবমাননাকর ছবির ব্যাপারে উত্তম বড়ূয়ার কোনো দায় নেই। কিন্তু তা খতিয়ে না দেখেই স্থানীয় লোকজন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ উত্তেজনার উৎস কী? মানলাম, সাধারণ লোকজন না বুঝে একে উত্তমের অপকর্ম হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে সে জন্য ব্যক্তি উত্তমের পরিবর্তে বৌদ্ধ সম্প্রদায় কেন টার্গেট হবে? এ প্রশ্ন কেন তাদের মধ্যে জাগল না? সাম্প্রদায়িকতার কারণেই উত্তম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের টার্গেট করা হয়েছে, তা অস্বীকার করার জো নেই। ঘটনার পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, এটি পূর্বপরিকল্পিত। এর পেছনে আরও লম্বা হাতও থাকতে পারে। বাইরে থেকে বাসে, ট্রাকে লোক এসে হামলাকারীদের সঙ্গে মিলেছে। এমন প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে।
এ কথা সত্য, রামুর সবাই ওই অপকর্মে যোগ দেয়নি। অনেকেই ঘরে বসে থেকেছে বা দাঁড়িয়ে ধ্বংসালীলা দেখেছে। ইদানীং বাংলাদেশে অতীতের মতো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে জনতার শক্তির বহিঃপ্রকাশ দেখছি না। আমরা রামুতে সেভাবে দেখিনি। কিন্তু প্রতিরোধের উদ্যোগ একেবারে ছিল না বলা যাবে না। ডেইলি স্টারে 'হিরোস অব আওয়ার টাইম' শিরোনামে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ৬ যুবক হামলাকারীদের প্রতিরোধে এগিয়ে যায়। ৬ থেকে তাদের সংখ্যা ৩০ জনে পরিণত হয়। প্রাথমিকভাবে তারা আক্রমণকারীদের ঠেকিয়ে রাখতে পারলেও যখন রামুর বাইরে থেকে আক্রমণকারী এসে পড়ে, তখন তারা রুখে দাঁড়াতে পারেনি। এখন খতিয়ে দেখার ব্যাপার, এই শক্তি ৩০ জন থেকে ৩০০ কিংবা ৩ হাজারে পরিণত হতে পারল না কেন? সেটি ঘটলে আমরা গণমাধ্যমে নতুন এক শিরোনাম দেখতাম_ জনতার প্রতিরোধে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলাকারীদের পিঠটান কিংবা হামলাকারীরা জনতার হাতে ধৃত।
উত্তেজিত জনতাকে প্রশমিত করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার দায়িত্ব ছিল পুলিশের। কিন্তু সে দায়িত্ব তারা যথার্থভাবে পালন করেনি, বরং থানার ওসি হামলাকারীদের সমাবেশে বক্তব্য রেখে তাদের উস্কে দিয়েছেন। হামলার সময় বা পরে পুলিশের এই ভূমিকা ধ্বংসযজ্ঞে ইন্ধন জুগিয়েছে।
এমন সাম্প্রদায়িক হামলা রুখে দাঁড়ানোর কথা ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের। তারা সেই দায়িত্ব পালন করল না বরং ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাত্রলীগ নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রাখলেন এবং স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের অপকর্মে শরিক হতে দেখা গেল।
সংবাদপত্রে প্রকাশ, ওই অপকর্মে ১৬ থেকে ২২ বছরের তরুণরা অগ্রগামী ছিল। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এই বয়সের তরুণরা ইতিহাস গড়েছে_ অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক চেতনার ঝাণ্ডা তুলে ধরে। একাত্তরে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে এই তরুণরাই। কিন্তু আজ তাদের এই ধ্বংসাত্মক ভূমিকা দেখে সত্যিই বেদনাবিদ্ধ হতে হয়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও পুলিশের ভূমিকায় আমরা হতবাক। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলো প্রযুক্তির এই উৎকর্ষিত যুগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবহিত হলো না, গোয়েন্দারা ভূমিকা রাখল না, তা কী করে সমর্থন করা যায়!
যেখানে পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় উগ্রতার বীজ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব আদর্শচ্যুত, যুবসমাজ বিভ্রান্ত, নাগরিক উদ্যোগ অনুপস্থিত; সেখানে সাম্প্রদায়িকতা, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন প্রতিরোধ কতটুকু সম্ভব?
একে স্থানীয় ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ঘটনাটি রাজনৈতিক-প্রশাসনিক এবং সামগ্রিক ব্যর্থতারই জ্বলন্ত উদাহরণ। এ ঘটনায় সরকার ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু কৃত অপরাধের জন্য কি তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? জানা গেছে, বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা যেটি করেছেন সেটি সাম্প্রদায়িক হামলায় ইন্ধন জোগানোর শামিল। তাই কেবল বিভাগীয় তদন্ত ও শাস্তির পাশাপাশি তাকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে বিচার করা উচিত।
হামলার পর সপ্তাহ গড়িয়ে গেল। কিন্তু রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা দূরে থাক তাদের শাসানো হয়েছে এমনটিও শুনিনি। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, পথভ্রষ্ট কর্মীদের বিরুদ্ধে নেতারা সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ। নিজেদের সংগঠনের কৃত অপরাধ আমলে না নিয়ে একে অন্যের দোষ দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চেষ্টা করছেন। সরকার বিরোধী দলকে এবং বিরোধী দল সরকারকে দায়ী করছে। রাজনীতির গোলকধাঁধায় জনগণ দিশেহারা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জঙ্গিদের দমনের কৃতিত্ব দাবি করছে। তাদের এ সাফল্যকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। কিন্তু সব সাফল্য গ্রাস করছে সাতক্ষীরা-হাটহাজারী-রাঙামাটি-রামু-উখিয়া-পটিয়ায় সংঘটিত অমানবিক ও সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলি। থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের এ অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ।
এ কথা আড়াল করার সুযোগ নেই যে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ আজ দুর্বল ও ক্ষণভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। একদা গৌতম বুদ্ধের অহিংসবাণী, সুফি-বৈষ্ণব-ফকির-সন্ন্যাসীদের অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা, বাউলদের মানবদর্শন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সংহতি রচনা করেছে। বাংলার জনগণ সেই সভ্যতা ও ঐতিহ্যের উত্তরসূরি। তবে ওহাবি আন্দোলন, হিন্দু ও ব্রাহ্মণবাদ উত্থান প্রচেষ্টা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মভিত্তিক ভারত বিভাজন, পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর ধর্মীয় জিগির ইত্যাদি সেই সম্প্রীতির বন্ধন কিছুটা দুর্বল করলেও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন তা পুনরুজ্জীবিত করেছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা সাম্প্রদায়িকতার কবর রচনা করেছি। ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছি; কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা আমরা করিনি।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত রেখে এখানে কখনও উগ্র বাঙালিত্ব, কখনও উগ্র মুসলমানিত্ব চর্চা করা হয়েছে। আর '৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে নির্বাসিত করে সংবিধানে ধর্মীয় ছাপ এঁটে এবং পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রধর্ম নীতি করে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি প্রতিযোগিতামূলকভাবে 'কে কত মুসলমান' প্রমাণ করতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করেছে, যে ধারা এখনও অব্যাহত। পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপিত হলেও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে তা বিতর্কিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের কথাই সত্য_'গোঁজামিল দিয়ে কোনো শুভকাজ হয় না। সেই গোঁজামিল সংবিধানে আমরা করেছি। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা ঘোষণা করেছি, অন্যদিকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে রেখে দিয়েছে। তারই বলি হচ্ছে রামুর ঘটনা।'
গোঁজামিল নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির অনুসরণই অপতৎপরতা রোধের যৌক্তিক পথ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্র ব্যবহার করতেই পারে। তবে রাজনীতি যদি সঠিক লক্ষ্যে অগ্রসরমান হয়, জনগণ সজাগ থাকে, তবে তা কখনোই ফলপ্রসূ হয় না। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের দায় সর্বাধিক। সংখ্যার বিচারে ধর্মীয় দিক থেকে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু এবং নৃতাত্তি্বক বা জাতিগতভাবে বাঙালিরা সংখ্যাগুরু। তাই সঙ্গতভাবেই বাঙালি ও মুসলমানদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে উদারতার পরিচয় দিতে হবে। তবে রাজনীতি যদি মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবমুক্ত না হয়, তাহলে সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল হবে না। সে বিবেচনায় অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ক্ষেত্র প্রসারিত করা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। বদলাতে হবে রাষ্ট্র যন্ত্রটাও, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতার শিকড় গজিয়েছে। সব শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সেই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন, যাতে তারা সব ধর্ম, বর্ণ, জাতির মানুষকে একই চোখে দেখে, স্বধর্মীয় বা স্বজাতির অপরাধীদের যেন প্রশ্রয় না দেয়।
রামুর দায়িত্ব পালনে নিস্পৃহ ও বৈরী পুলিশ, বিভ্রান্ত রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্য দিয়েই প্রতিরোধক শক্তি জোরদার হবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments:

Post a Comment