রামুর সাম্প্রদায়িক হামলা : সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে সংশয়
উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা দায়ী, আ'লীগ-বিএনপি মুখোমুখি
কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৌদ্ধবিহার ও বসতিতে হামলা, ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ঘটনার জন্য একে অপরকে দায়ী করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। এ পরিস্থিতিতে প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়বে কিনা এবং তাদের বিচার হবে কিনা তা নিয়ে দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিশিষ্টজন এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। একই আশঙ্কা করেছেন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা। ঘটনার জন্য এ সব মহলের পক্ষ থেকে উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধদের দায়ী করা হয়েছে। অন্যদিকে নিরপেক্ষ ও সঠিক তদন্তের দিকে মনোনিবেশ না দিয়ে ঘটনার দায় চাপাতে পাল্টাপাল্টি অভিযোগে ব্যস্ত প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। জানতে চাইলে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সাধারণ সম্পাদক তরুণ বড়ুয়া 'সংবাদ'কে বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাদা ছুড়াছুড়ি দেখতে চাই না। আমরা চাই সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীরা বের হয়ে আসুক। এক প্রশ্নের জবাবে এই বৌদ্ধ নেতা বলেন, আমাদের মধ্যে কখনও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছিল না। যে ঘটনা ঘটেছে তা পরিকল্পিত। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করছে। তারাই খুঁজে বের করবে প্রকৃত অপরাধী কারা। আশা করছি প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে।
কক্সবাজারের রামুতে বিরোধীদলের সংসদ সদস্যকে জড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্য তদন্ত কাজকে প্রভাবিত করবে বলে মনে করেন আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামক সংগঠনের নেতারা। তাছাড়া সরকারকে জড়িয়ে বিরোধীদলের নেতা খালেদা জিয়ার বক্তব্যও তদন্তকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেও এসব সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে গত ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বরের ওই ঘটনা সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস এবং তা পরিকল্পিত ছিল বলেও এসব সংগঠনের নেতারা অভিযোগ করেছেন।
সাম্প্রদায়িক এ হামলাকে রাজনৈতিক ইস্যু করে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলতে থাকলে ঘটনার সঠিক তদন্ত সম্ভব হবে না বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি 'সংবাদ'কে বলেন, এ ঘটনাটিকে সম্পূর্ণ রাজনীতিকরণের বাইরে রাখতে হবে। রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি এ ঘটনাটি পরিকল্পিত। এর জন্য উগ্র সাম্প্রদায়িকতাই দায়ী। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনারও দাবি জানিয়েছেন তিনি। তাছাড়া স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে কখনও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব ছিল না। কিন্তু এখন সেই আস্থায় ফাটল ধরেছে। তাই সব রাজনৈতিক দল বিশেষ করে প্রধান দুই দলের উচিত হবে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ বাদ দিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এগিয়ে নেয়ায় সহযোগিতা করা।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল 'সংবাদ'কে বলেন, প্রধান দুই দল যেভাবে কথা বলছে তাতে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা এক রকম বলছেন, অন্যদিকে বিরোধীদলের নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। এতে করে অতীতেও দেখা গেছে কোন তদন্তই ঠিকমতো শেষ হয়নি। এক্ষেত্রে তদন্ত কাজে যারা নিয়োজিত থাকেন তাদের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। একদিকে সরকারের চাপ, অন্যদিকে ভয় হচ্ছে- বিরোধীদল ক্ষমতায় এসে কঠোর ব্যবস্থা নিবে। তাই রামুর ঘটনার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকার ও বিরোধীদলের চুপ থাকা উচিত বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে, এটা সব দলের উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধরা ঘটিয়েছে। ঘটনার দিন উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সংসদ সদস্য একই সঙ্গে বসে মিটিং করেছেন।
বিচ্ছিন্ন এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশ এখনও রুগ্ণ রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত হয়নি। কোন ঘটনা ঘটলেই সরকার ও বিরোধীদল একে অপরের উপর দোষ চাপাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তদন্তের আগেই মন্তব্য করে বিষয়টি ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। ফলে আসল অপরাধীরা চলে যায় পর্দার আড়ালে। ড. কামাল আরও বলেন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর যে হামলা হয়েছে তা প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়। এটা জাতীয় ইস্যু। জাতীয় বিষয় হিসেবেই নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করতে হবে। হামলাকারী যে দলেরই হোক, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে এর পেছনের উসকানিদাতাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। তবে প্রধান দুই দলের রাজনৈতিক বক্তব্যে তদন্ত কতদূর এগোবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বিশিষ্টজনদের অভিযোগ, অতীতেও প্রধান দুই দলের কাদা ছুড়াছুড়ির কারণে এমন অনেক ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি, ধরা পড়েনি প্রকৃত অপরাধীরা। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলাসহ এমন অনেক ঘটনার কোন সুরাহা আজ পর্যন্ত হয়নি। এর জন্য বিশিষ্টজনেরা আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রতিহিংসার রাজীতিকে দায়ী করেছেন। রামুর ঘটনাও সেই একই দিকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তদন্ত কাজ শুরু হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পরস্পরবিরোধী অভিযোগে তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
এদিকে এ হামলার ঘটনায় সরকারকে দায়ী করেছে বিএনপির তদন্ত দল। সরকারের পরোক্ষ ইন্ধনেই এ হামলা হয় বলেও দলের ৬৭ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অতিদ্রুত একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনেরও দাবি জানিয়েছে দলটি। তবে ঘটনার প্রথম দিনেই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই একই অভিযোগ করেছিলেন বিরোধীদলের নেতা খালেদা জিয়া। তখন ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করেছিলেন তিনি। এরপর তিনি হবিগঞ্জ জনসভায়ও একই অভিযোগ করেন। ওই জনসভায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, কক্সবাজারের রামু ও চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় সরকার জড়িত। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত। আর সরকার এখন তাদের গ্রেফতার না করে বিরোধীদলের ওপর দায় চাপাচ্ছে।
বিরোধীদলের এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রামুতে বৌদ্ধবিহার ও বসতিতে সহিংস হামলার জন্য আবারও বিএনপির স্থানীয় সংসদ সদস্যকে দায়ী করে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, যখন একটা জায়গায় এ রকম ঘটনা ঘটতে থাকে তখন একজন জনপ্রতিনিধি বাড়িতে গিয়ে ঘুমায় কী করে? এটাই বড় প্রশ্ন। এর জবাব বিএনপিকেই দিতে হবে। তাছাড়া বিরোধীদল অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে অভিযোগ করে তাদের মিথ্যাচার সম্পর্কে দেশবাসীকে সজাগ থাকারও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধবসতি পরিদর্শন শেষেও প্রধানমন্ত্রী বৌদ্ধমন্দির ও বৌদ্ধদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগের জন্য বিএনপির স্থানীয় সংসদ সদস্য লুৎফর রহমানকেই সরাসরি দায়ী করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেদিন রাত সাড়ে ১১টায় যখন এখানকার (রামু) মানুষ শান্ত হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন স্থানীয় সংসদ সদস্য এসে মানুষকে কী বলে গেলেন যে তিনি চলে যাওয়ার পর মন্দিরে আগুন লাগানো শুরু হলো? প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার প্রশ্ন, তিনি (সংসদ সদস্য) কী কথা বলে গেলেন, কী উসকানি দিয়ে গেলেন তা বলতে হবে। মন্দিরে হামলার জন্য তিনিই দায়ী। অথচ তার নেত্রী (খালেদা জিয়া) আওয়ামী লীগকে দায়ী করছেন।
পাল্টাপাল্টি এ অভিযোগ শুধু প্রধান দুই নেত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দুই দলের মুখপাত্রসহ অন্য জ্যেষ্ঠ নেতারা প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করছেন। এক্ষেত্রে বিশিষ্টজনদের অভিমত, প্রধান দুদল আন্তরিক না হলে প্রকৃত হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে না। এতে কোন তদন্ত কাজই সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সরকারি দলের লোকজন জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা সম্ভব হবে না। প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে গোয়েন্দাসহ তদন্তে নিয়োজিত সংস্থাগুলো প্রভাবিত হবে। অপরদিকে বিরোধীদলের নেতা যে বক্তব্য দিয়েছেন সেজন্য তাদের দলের তদন্ত প্রতিবেদন জনমনে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সর্বোপরি আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় সাম্প্রদায়িক এ হামলার প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালেই থেকে যাবে বলেও বিশিষ্টজনদের আশঙ্কা
No comments:
Post a Comment