Tuesday, 16 October 2012

নৈতিকতার কাঠগড়ায় জাতি তারিখ: ১৭-১০-২০১২

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ঘটে যাওয়া বহুল আলোচিত, অত্যন্ত দুঃখজনক ও ন্যক্কারজনক ঘটনা, রামুসহ অন্যান্য অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক লেখা হয়েছে। বিভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা হচ্ছে। তবুও একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে, ওই অঞ্চলে চাকরিজীবনে বেশ কিছু সময় কাটানোর সুবাদে আমার বিশ্লেষণ তুলে ধরছি।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি পুরোনো গল্প নতুন করে উত্থাপন করতে চাই। গল্পটি কয়েক বছর আগে একজন স্বনামধন্য প্রবন্ধকার লিখেছিলেন। রামু, উখিয়াসহ অন্যান্য স্থানের ঘটনার সঙ্গে এর বেশ সামঞ্জস্য আছে বলে আমার মনে হয়েছে। গল্পটি সংক্ষেপে এ রকম: 
একদিন সূর্যাস্তের সময় শয়তান এক গ্রামের মুদি দোকানের সামনে দাঁড়াল। সঙ্গে তার এক বন্ধু। মুদি দোকানে বেশ কয়েকজন সামনের বেঞ্চে বসে বিড়ি সেবনে রত। দেশের হালহকিকত, রাজনীতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপকারিতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলছে। শয়তানের বন্ধুটি হঠাৎ বলে উঠল, ‘এখানে লোকজন তো বেশ হাসিখুশি-সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী বাস করছে। তুমি এখানে কী করতে পার?’ শয়তান কিছুই বলল না। মুচকি হাসল। মুদি দোকানের গুড়ের ভাঁড় থেকে আঙুলে সামান্য গুড় নিয়ে মুদি দোকানের ঝাঁপির বাঁশে লাগিয়ে দিল। ঝাঁপির নিচে ওই অঞ্চলের সব ধর্মের বয়সের লোক আড্ডায় রত। ঝাঁপির বাঁশের মাথায় গুড় খেতে মাছি বসা শুরু হয়ে গেছে দেখে শয়তান তার বন্ধুকে নিয়ে দূরে সরে গিয়ে ইশারায় তামাশা দেখতে বলল। ততক্ষণে বেশ কিছু মাছি, পিঁপড়াসহ অন্যান্য পোকামাকড় গুড় চাটতে ভিড় করল। বাঁশের গোড়ায় হূষ্টপুষ্ট এক টিকটিকি ওত পেতে ছিল, সে আস্তে আস্তে বাঁশের মাথায় উঠে পোকামাকড় খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নিচে বসা একজনের পোষা বিড়ালও অনেকক্ষণ টিকটিকিকে তাক করে ছিল। হঠাৎ বিড়াল লাফ দিয়ে টিকটিকি ধরতে বাঁশে উঠতে চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে বাঁশ সরে গিয়ে ঝাঁপি পড়ল এক বৃদ্ধের মাথায়। মাথা ফেটে চৌচির। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। এর পর কোনো একজন লাঠি দিয়ে বিড়ালের মাথায় মারলে বিড়াল মৃতবৎ পড়ে রইল। পাড়ার কুকুরগুলো এতক্ষণে বিড়ালটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিড়াল আর কুকুরের মনিবদের মধ্যে বাদানুবাদ হতে হতে আশপাশের দুই গ্রামের এত যুগের সৌহার্দ্য ভেঙে পড়ল। শুরু হলো দাঙ্গা। গ্রাম জ্বলল, বাড়িঘর জ্বলল। মৃত বিড়ালটি কোন বাড়ির অনুচর, তা নিয়ে চলল তুলকালাম কাণ্ড। বের হলো মিছিল। মন্ত্রী-সান্ত্রিদের দৌড়ঝাঁপ। বসল তদন্ত। চলল বসচা। দূরে দাঁড়ানো শয়তান। তার আঙুলে গুড় তখনো লাগানো। সে মুচকি হেসে ভিন গ্রামে গুড় লাগাতে স্থান ত্যাগ করল। তত দিনে মুদির দোকানদারসহ শত শত লোক হাজতে। আসল রহস্য বের হলো না রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে।
এ গল্পের সঙ্গে রামুর ঘটনার কোনো সাযুজ্যই নেই। কিন্তু বেশ কিছু প্রশ্ন থেকে যায়, যার উত্তর পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। কেননা প্রথম থেকেই রাজনৈতিক বিতর্ক জমে উঠেছে। যদিও ইতিমধ্যে আবদুল মুক্তাদির ও ফারুক নামের দুই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে উত্তম বড়ুয়া, যার ফেসবুক নিয়েই এ ঘটনা, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না জানা যায়নি। তার পরিবারের সদস্যদের পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। এখানে মূল প্রশ্ন হলো, কেন এই হামলা? বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব আগেও হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধদের ওপর, বিশেষ করে তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের ওপর এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেনি। 
পরিসংখ্যান মোতাবেক বাংলাদেশে বর্তমানে জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলেই এই জনগোষ্ঠীর বাস। বাংলাদেশের বৌদ্ধ-অধ্যুষিত এই অঞ্চলের সঙ্গেই রয়েছে অভিন্ন জল ও স্থলসীমা পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম বৌদ্ধ-অধ্যুষিত দেশ মিয়ানমার, যেখানে বৌদ্ধ ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা শুরু হয়েছে ১৯৫৮ সালে জেনারেল নে উইনের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই। ওই প্রক্রিয়া এখনো চলছে।
আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় প্রতীয়মান হয়েছিল যে, বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় কখনোই অন্য ধর্মের প্রতি বিরাগভাজন ছিল না। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘাতের শেষ দিকে বৌদ্ধসহ কিছু কিছু জনগোষ্ঠীকে ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার প্রচেষ্টার পর থেকে এই অস্থিরতা বেড়ে যায়। ওই সব অঞ্চলে বর্তমানে একদিকে ইসলামি, অন্যদিকে খ্রিষ্টান ধর্মীয় ভাবধারার এনজিওগুলোর তৎপরতা বেড়েছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রচুর অর্থ আসছে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের নামে। রামু, উখিয়া, চকরিয়ায়—এমনকি টেকনাফ, কক্সবাজারের অনেক অঞ্চলে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে এবং কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে রাজনৈতিক ও অনৈতিক অর্থনৈতিক খেলা অব্যাহত রয়েছে। 
রোহিঙ্গাদের ভোটব্যাংক হিসেবে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় সংগঠন ব্যবহারের জন্য ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টা অতীতের মতো বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। ২০১১ সালে হালনাগাদ করা ভোটার তালিকা থেকে প্রায় ৪০ হাজার নাম বাদ দিতে হয়েছিল। এমনকি চট্টগ্রামের তালিকা থেকেও সন্দেহভাজন রোহিঙ্গাদের বাদ দিতে হয়েছিল। এসব শরণার্থী রোহিঙ্গাদের সস্তা দিনমজুর হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন চিংড়ি ও লবণের ঘেরের মালিকেরা, যাঁরা রাজনৈতিকভাবেও যথেষ্ট প্রভাবশালী। বিগত মাসগুলোতে রাখাইন অঞ্চলে যে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, ওই সময়ও কক্সবাজার, নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফ অঞ্চলের বহু প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, এমনকি দাঙ্গায় ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ উঠেছিল। কাজেই রামুসহ অন্যান্য অঞ্চলের ঘটনায় সব দলের ইন্ধন থাকার অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
স্থানীয় উসকানির বিষয়টি ছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খতিয়ে দেখা উচিত হবে: সীমান্ত পার হতে গোয়েন্দা তৎপরতা। উল্লেখ্য, মিয়ানমার প্রায় পাঁচ দশক সামরিক জান্তা কঠোর হাতে শাসন করেছে, এখনো করছে। যদিও হালে গণতন্ত্রায়ণের পথে রয়েছে বলে মনে করা হয়। সামরিক কাউন্সিল, স্টেট অব পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল, যতই উদার হোক না কেন, মিয়ানমারে ধর্মীয় অনুভূতির ব্যবহার যেমন চলছে, তেমনি কাউন্সিলের অভ্যন্তরেই শুরু ক্ষমতার দ্বন্দ্বের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এমতাবস্থায় রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গা নিয়ে বিব্রত হতে হয়েছে উদারপন্থীদের, দোষারোপ করা হয়েছে বাংলাদেশের কিছু উগ্রপন্থী সংগঠনকে, যার মধ্যে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনও ছিল। এসব সংগঠন বিভিন্ন সূত্র থেকে রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা প্রচারের মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করে থাকে। এদের মধ্যে যে মিয়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থার অনুপ্রবেশকারীরা নেই, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। প্রসঙ্গত, মিয়ানমার সরকারের হাতে রয়েছে এক ডজনের অধিক গোয়েন্দা সংস্থা, যার মধ্যে সীমান্ত এলাকায় সবচেয়ে বেশি তৎপর ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত অফিস অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (ওএসএস), যার অন্তর্ভুক্ত ডিফেন্স সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (ডিএসআইবি)। আমাদের দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হলফ করে বলতে পারবে না যে মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে এদের এজেন্ট নেই। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী তরুণেরাও অহরহ নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রাখাইন হয়ে মিয়ানমারের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করছে। এমনকি ধর্মীয় শিক্ষার জন্যও গিয়ে থাকে। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে এসব খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
লেখাটি শেষ করব কয়েকটি প্রশ্ন রেখে। 
প্রথম প্রশ্ন হলো, ঘটনাটি যে পূর্বপরিকল্পিত, তাতে সন্দেহ নেই। সে অবস্থায় গুড় লাগিয়েছিল কে? কে এই উত্তম কুমার বড়ুয়া? যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের অর্থায়নের উৎস কী? রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততা চিহ্নিতকরণ। তদন্তের সবচেয়ে বড় দিক হতে হবে গোয়েন্দা ব্যর্থতা। ওই অঞ্চলে সব সময়ই গোয়েন্দা তৎপরতা থাকে সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে রাখাইন অঞ্চলে দাঙ্গার পর। ওই অঞ্চল মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য। কক্সবাজার দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র, তাই সেখানে গোয়েন্দা তৎপরতাও বেশি থাকার কথা। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, বেসামরিক প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা। জেলা প্রশাসক ক্ষমতাবলে যেকোনো বাহিনী তলব করতে পারতেন। রামুসহ ১০-১২ কিলোমিটারের মধ্যে দুটি বিজিবি ব্যাটালিয়ন নিয়োজিত ছিল। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগও খতিয়ে দেখা উচিত। সেনাবাহিনীর অবস্থানও কাছাকাছি। জেলা প্রশাসক নিজ ক্ষমতাবলে যেকোনো বাহিনীকে নিয়োগের নির্দেশ দিতে পারতেন। কেন দিতে পারেননি বা দেননি, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। হয়তো তদন্তে পাওয়া যেতে পারে। 
যা হোক, যা ঘটেছে, সেটাও হঠাৎ ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলা। এটাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে এমন ঘটনা বাংলাদেশে আগে ঘটেনি। জাতি হিসেবে আমরা যে মর্মাহত, তা প্রকাশ করার ভাষা নেই। তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যে ঘটনা ঘটেছে, তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করি। স্থানীয় পর্যায়ে নয়, জাতীয় পর্যায়ে তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। সঠিকভাবে ঘটনার কারণ ও এর হোতাদের চিহ্নিত না করতে পারলে বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য ক্ষুদ্র স্বার্থের রাজনীতির বলি হবে। 
সরকারের উচিত হবে নির্মোহ তদন্তের ব্যবস্থা করা, অন্যথায় সমগ্র জাতিকে নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। 
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com

No comments:

Post a Comment