Sunday 7 October 2012


Ittefaq Logo

রামুতে এখনো আতংক দুই শতাধিক গ্রেফতার, নেপথ্য নায়করা ধরা পড়েনি

লেখক: আবুলখায়ের  |  সোমবার, ৮ অক্টোবর ২০১২, ২৩ আশ্বিন ১৪১৯
Details
বর্বরোচিত হামলার নয় দিন অতিবাহিত হলেও কক্সবাজারের রামু উপজেলায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে এখনও আতংক বিরাজ করছে। হামলার ঘটনায় গতকাল রবিবার পর্যন্ত দুই শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলেও নেপথ্য পরিকল্পনাকারীরা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ কারণে উপজেলার বৌদ্ধ পরিবারগুলো অজানা আতংকে ভুগছে। ফের নাশকতার আশংকায় প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। কর্মস্থলেও যেতে পারছেন না অনেকেই। ছাত্র-ছাত্রীরাও স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কাজ করতে না পারায় চরম আর্থিক কষ্টে পড়েছে দিনমজুর পরিবার-গুলো। এরকম পরিস্থিতিতে আজ রামুতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর আগমনের সংবাদে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে।  এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ ও কাল দুই দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে উপজেলার ১২টি বৌদ্ধ মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় মন্দিরের পাশে বৌদ্ধপল্লিতেও হামলা চালানো হয়। পরদিন উখিয়া-টেকনাফেও সহিংস ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১৬ মামলায় গতকাল পর্যন্ত ২০৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৪০ জন বিএনপি ও জামায়াত-শিবির কর্মী বলে জানা গেছে। তবে হামলায় নেতৃত্বদানকারীরা এখনও গ্রেফতার না হওয়ায় মানুষের মাঝে আতংক রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। তারা বলেছেন, এখানে মুসলিম ও বৌদ্ধরা সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করলেও কিছু উগ্রপন্থী যেভাবে গভীর রাতে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে- তা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কোন কোন কর্মকর্তা হামলাকারীদের সহযোগিতা করেছে। পরিকল্পিত এ হামলা সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও প্রশাসনকে আগাম তথ্য না জানিয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। কোন কোন মহল হামলায় ইন্ধন দিয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, রামুতে হামলার ঘটনায় জড়িতদের ছাড় দেয়া হবে না।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর বলেন, গ্রেফতারকৃত ২০৩ জনই প্রকৃত আসামি এবং তারা হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। অনেককে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, হামলার সময় দায়িত্ব পালনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে কিনা তা তদন্ত কমিটির রিপোর্টেই প্রমাণিত হবে। বর্তমানে রামুতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে পুলিশ সুপার জানান।
৬২ জন রিমান্ডে, চালকের স্বীকারোক্তি
কক্সবাজার প্রতিনিধি আহমদ গিয়াস জানান, বৌদ্ধ মন্দির এবং পল্লিতে হামলার ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আটটি মামলায় ১০৫ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ৬২ জনকে রিমান্ডে আনা হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল ১১ জনকে রিমান্ডে আনা হয়। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পর গতকাল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে ঘটনার রাতে ব্যবহূত একটি ট্রাকের চালক রমজান আলী। সে কক্সবাজার শহরতলীর হাজীপাড়ার বাসিন্দা।
যেমন আছেন ভুক্তভোগীরা
ঘটনার রাতে আক্রান্ত রামুর হাইটুপি এলাকার বাসিন্দা পেশায় চালক অমূল্য বড়ুয়া জানান, তিনি ঘটনার রাতে বাড়ী ফিরে ভাত খাচ্ছিলেন, এমন সময় অসংখ্য মুসলিম উচ্ছৃঙ্খল যুবক তাদের পাড়ায় হামলা চালায়। এ সময় তিনি সপরিবারে ধানক্ষেতে আশ্রয় নিলেও আতংকের কারণে এখনও কর্মক্ষেত্রে ফিরতে পারেননি।
একই কথা জানান তার প্রতিবেশী রাজমিস্ত্রী জিটু বড়ুয়া  (৫২)। তিনি জানান, মুসলমানদের ঘরবাড়ী নির্মাণ করেই তার জীবিকা নির্বাহ হয়। কিন্তু ওইদিনের ঘটনার পর তিনি কাজে যেতে পারছেন না আতংকে। ফলে চরম আর্থিক অনটনে তার দিন কাটছে। কিন্তু কেউ সাহায্যেও এগিয়ে আসছে না।
হাইটুপির অমূল্য বড়ুয়া র কলেজ পড়ূয়া কন্যা রিপা বড়ুয়া  ঘটনার পর থেকে বাড়িতে বন্দী হয়ে আছেন। কলেজে যাওয়ার পথে তার ওপর কেউ যদি হামলা করে বসে- এই আতংকে কলেজে যাচ্ছেন না বলে জানান রামু কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী রিপা বড়ুয়া । তার মত একই কথা জানান, রিপার বান্ধবী ও সহপাঠী সূবর্ণা বড়ুয়া  (১৮)।
ওইদিনের ঘটনার পর থেকে রামু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ও মধ্যম মেরংলোয়ার প্রদীপ বড়ুয়া র কন্যা আঁঁখি বড়ুয়া , প্রতিবেশী ইভান বড়ুয়া সহ বেশিরভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীই স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে । কিন্তু কতদিন এভাবে চলবে, কবে স্বাভাবিক অবস্থা আসবে - একথা কেউ বলতে পারছে না ।
রামুর ইউপি মেম্বার অরূপ বড়ুয়া  বলেন, আমরা আগের মতই সব ধর্মের লোক একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করতে চাই। কারণ আমরা বাঙালি। আমাদের যাওয়ার আর কোন দেশ নেই।
রামুর এমপি, এসপিকে আইনের আওতায় আনার দাবি
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, রামুর বৌদ্ধ বিহার ও পল্লিতে সহিংসতার ঘটনায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগে ওই এলাকার সংসদ সদস্য, পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। রামুর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের পর রবিবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
এতে বলা হয়, রামুর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বসতিতে হামলার ঘটনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য লুত্ফর রহমান কাজল, এসপি সেলিম মো. জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আখতারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাও এ ঘটনায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের উপদেষ্টা ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. অনুপম সেন, পরিদর্শন দলের সদস্য ও পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ ও সিইউজের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, কেন্দ ীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও চবি শিক্ষক প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন।  লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের জেলা সাধারণ সম্পাদক শওকত বাঙালী।
সংবাদ সম্মেলনে দেশে যে কোন সময় আরও বড় ধরনের যে কোন ঘটনা ঘটার আশংকা প্রকাশ করে ড. অনুপম সেন বলেন, এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের আরও নানা ঘটনা ঘটবে। গণতন্ত্র, অসামপ্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করতে হবে।
প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, আমরা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, রাত ১টার পর মাথায় টুপি পরিহিত রোহিঙ্গা সমপ্রদায়ের লোকজন হামলা করে। আর কক্সবাজারের এসপি ঘটনাস্থলে যান রাত ৩টায়। সুতরাং এসপিসহ স্থানীয় প্রশাসন, সংসদ সদস্য কেউই এ ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না।
জড়িতরা যে দলেরই হোক রেহাই পাবে না-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীর বলেছেন, রামুর ঘটনায় জড়িত অপরাধীরা যে দলেরই হোক তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। রামু ও উখিয়ার বৌদ্ধ উপাসনালয়ে হামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা উস্কানি দিয়েছেন বলে অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। এরপরও তদন্তে নিজ দলের কারো জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। গতকাল চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বাইতুল ইজ্জত ট্রেনিং সেন্টারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৮১তম ব্যাচের রিক্রুট সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
হামলার প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে মানববন্ধন
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের পটিয়াতে বৌদ্ধ মন্দির ও হিন্দু মন্দিরে অগ্নিসংযোগ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বসতবাড়িতে হামলা লুটপাটের প্রতিবাদে গতকাল শহরের শাপলা চত্ত্বরে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। মানববন্ধনে স্থানীয় সংসদ সদস্য যতীন্দ  লাল ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কুজেন্দ  লাল ত্রিপুরা, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শানে আলম, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া প্রমুখ সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। মানববন্ধন কর্মসূচিতে বিভিন্ন সমপ্রদায়ের শত শত সচেতন নাগরিক যোগ দেন।

No comments:

Post a Comment