Sunday 14 October 2012

রামু ট্র্যাজেডি : সম্প্রীতি বজায় রাখুন


ঢাকা, রোববার, ১৪ অক্টোবর ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ

২৯ আশ্বিন ১৪১৯ বঙ্গাব্দ | ২৭ জিলকদ ১৪৩৩ হিজরী

রামু ট্র্যাজেডি : সম্প্রীতি বজায় রাখুন

প্রশান্ত বড়–য়া
ফেসবুকে পবিত্র কুরআন শরিফের অবমাননাকর জঘন্য ছবির একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথমে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলা ও পরে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় বৌদ্ধবিহার ও হিন্দুদের মন্দিরে ব্যাপক হামলা এবং বৌদ্ধমূর্তি ও প্রতিমা ভাঙচুর, লুটপাট হয়েছে। এতে ভস্মীভূত হয় বৌদ্ধ  ধর্মাবলম্বী বড়–য়া সম্প্রদায়ের বাড়িঘর। ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টা থেকে এ সন্ত্রাস অব্যাহত ছিল ভোর ৪টা পর্যন্ত।  রামু উপজেলার ১১টি বৌদ্ধবিহার, ২২টি বসতবাড়ি ও দোকানে অগ্নিসংযোগ করে দুষ্কৃতকারীরা।
আগুনে রামুতে জ্বলেছে বৌদ্ধবিহার, জ্বলেছে দোকান আর বাড়িঘর। নিঃস্ব হয়ে সেনাবাহিনী আর বিজিবির সাময়িকভাবে তৈরি করে দেয়া ঘরে রাত কাটাচ্ছে নিরীহ বৌদ্ধ নারী পুরুষ। তারা স্বাধীনতার সময় সব সম্প্রদায়ের সাথে মিলেমিশে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। যে বৌদ্ধবিহারগুলো আজ দুষ্কৃতকারীরা পুড়ে দিয়েছে সেসব বিহারে একদিন পাকিস্তানি মিলিটারিদের কাছ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অবস্থান নিয়েছিলেন অন্যান্য ধর্মের মানুষও। তাদের বুকে আগলে রেখেছিলেন বিহারের পুরোহিত ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথেরো। রামুর সদরে আজ সেই আশ্রয়দানকারী সিমাবিহার কিছু দুষ্কৃতকারীর হাত থেকে রক্ষা পেল না। বিহারগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে। ধ্বংস করেছে কয়েক শতাব্দীর ধর্মীয় ঐতিহ্য কৃষ্টি।
বৌদ্ধরা শান্তিপ্রিয় জাতি। অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী। তাদের ধর্মের মূল বাণী, অহিংসা পরম ধর্ম আর জীব হত্যা মহাপাপ। প্রকৃত ধার্মিক সাম্প্রদায়িকতায় কখনো বিশ্বাস করে না। তারা কী করে আরেকটি ধর্মকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য বা কুরআন শরিফকে অবমাননা করতে পারে? যদি কেউ কিছু করে থাকে তাহলে আইন আদালত বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। দোষীকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যায়। একটি সম্প্রদায় যে দেবতাকে মানে তার কী দোষ? বুদ্ধমূর্তির মাথা কেন দেহ থেকে আলাদা করে ফেলাত হবে? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতেই এ হামলা।
নিজে রামু গিয়ে এসব দেখে এসে লিখতে বসলাম। নিজে না দেখলে কখনো বিশ্বাস করতে পারবেন না যে, কত বীভৎস দৃশ্য। যারা কখনো কোনো দিন কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হাত দেয়নি তারা এমন কাজ করবে না। বৌদ্ধ সম্প্রদায় মাজার বা মসজিদ দেখলে হাত তুলে বা মাথা নিচু করে শ্রদ্ধা করতে ভুল করে না। দেখেছি, তিন শ’ বছরের পুরনো বুদ্ধমূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। কেউ অন্য কোনো ধর্মকে বা সম্প্রদায়কে পছন্দ না করলেও এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
এ ঘটনায় পুরো জাতি বাকরুদ্ধ। দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক। কারো কারো এ ঘটনায় লাভ হয়েছে তবে, যার বেশি ক্ষতি হয়েছে সেটা হলো রাষ্ট্রের। গোটা বিশ্ব আজ বিষয়টি অবগত হয়েছে। বিশ্বের কাছে  আমাদের  দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। বিশ্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি হলো বৌদ্ধ যদিও বাংলাদেশে বৌদ্ধরা সংখ্যালঘু। বৌদ্ধরা সব সম্প্রদায়ের সাথে শান্তিতে বসবাস করে আসছিল। হঠাৎ করে কেন কিছু লোক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে? ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো গরিব দেশগুলোতে মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়ে দিয়ে ফায়দা লোটে। আমরা কি ফিরে পাবো কয়েক শতাব্দীর আগের পুরনো বুদ্ধমূর্তি?’ ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে? বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের স্কুলপড়–য়া শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তাদের সামনে বসতবাড়ি পুড়ে দিয়েছে দুষ্কৃতকারীরা। কিছু দিন পর ওদের পরীক্ষা, কী করে তারা পরীক্ষায় অংশ নেবে? আজো শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন দিচ্ছে না বইপত্র? এ ছোট ছেলেমেয়েরা হিংসা-ঘৃণা নিয়ে বড় হোক, এটা আমরা চাই না। তারা বড় হয়ে জানবে কারা এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী।
এ ঘটনাকে তথ্য মন্ত্রী ‘বিচ্ছিন্ন’ বলেছেন। ক’টা বিহার পুড়িয়ে দিলে বিচ্ছিন্ন না হয়ে সত্যিকার ঘটনা হয়? প্রশাসনের ব্যর্থতার পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাফাই গাওয়া! এমনকি ঘটনার তদন্তের আগেই বিরোধী দলের সংসদ সদস্যকে দায়ী করে বক্তব্য দেয়া। আমাদের দেশে  দায়িত্বশীল মানুষের দায়িত্বজ্ঞান ও আচরণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কোনো ঘটনার পর শুধু বিরোধী দলের সম্পৃক্ততা আছে বা তারা জড়িত বলে মন্ত্রীরা সস্তা বাক্যটি ব্যবহার করে থাকেন খুব বেশি। কোনো তদন্ত না করে বা তদন্তাধীন, এমন বিষয়েও কাণ্ডজ্ঞানহীন কথা দায়িত্বশীল মানুষদের মুখ থেকে বের হয় কী করে?
এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের রহস্যজনক অসহযোগিতা সবার নজরে এসেছে। অনেকবার ভুক্তভোগীরা বলার পরও কাছে নেই প্রশাসন। যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারাই বলছেন, স্থানীয় প্রশাসন থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি। অথচ প্রশাসন সহযোগিতা করেছে কি না তা খতিয়ে না দেখে, সহসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিলেন প্রশাসন সহযোগিতা করেছে।’ যদি সময়মতো প্রশাসন উপস্থিত হতো তাহলে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটত না।
বর্বরোচিত হামলায় বৌদ্ধবিহার ও বসতি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া, এটা কোনো সভ্যসমাজের কাজ? স্বাধীনতার পরে ও আগে রামুতে এ ধরনের ঘটনা হয়নি। খোদ পাকিস্তানিরা পর্যন্ত কোনো দিন বিহারগুলোর ক্ষতি করার চেষ্টা করেনি। স্বাধীন হওয়ার ৪০ বছর পর এলাকারই কিছু মানুষ বৌদ্ধবিহারগুলো জ্বালিয়ে দিলো।
রামুর ঘটনাকে ঘিরে অনেক প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য মতে যদি ‘পরিকল্পিত’ ঘটনাই হয় তাহলে কেন আগেভাগেই জানল না সরকারের এতগুলো গোয়েন্দা সংস্থা? মিডিয়ার খবর মোতাবেক, কারা মাইক ব্যবহার করে হামলার জন্য ইন্ধন দিয়েছে? মধ্যরাতে কারা আনল গান পাউডার ও ¯েপ্র মেশিন? বহিরাগতরা কোন এলাকা দিয়ে কিভাবে এলো? স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নেপথ্য ভূমিকা কেমন ছিল? মিছিল ও সমাবেশের নেতৃত্বে কারা ছিল? ওরা কোন দলের কী পদে আছে?  কারা প্রথম মিছিলটি বের করেছিল?
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, সরকারি দলের সমর্থক কয়েকজনই প্রথমে একটি ছোট মিছিল বের করে। তারপর হাজার হাজার মানুষ আসতে শুরু করে। এতে বোঝা যায়, রাজনৈতিক দলের স¤পৃক্ততা থাকতে পারে।
কোনো সচেতন মুসলিম সমর্থন করতে পারেন না বা করবেন না এ ধরনের নারকীয় তাণ্ডবকে।  নাগরিক সমাজে ঝড় বইছে। ধর্মান্ধ কিছু দুর্বৃত্তের এ ঘটনায় বিবেকবানেরা বাকরুদ্ধ। এ রকম জঘন্য ঘটনা কেউ ঘটাতে পারে, তা অনেকে বিশ্বাসই করতে পারছে না। এ দিকে বসতবাড়ি আগুনে হারিয়ে নিঃস্ব জীবনযাপন করছে অনেকে। সংসার নতুন করে সাজাতে হবে। বুদ্ধমূর্তি আর ভিক্ষুদের মাথার ওপর ছাদ নেই। যারা দুই হাতে মানুষকে দান করতেন, তারা আজ অন্যের সাহায্যের অপেক্ষায়।
আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার নয়। এরাও বাংলাদেশের মানুষ। তাদের এখানে থাকার অধিকার আছে। সব সম্প্রদায়ের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। সবাই যেন সম্প্রীতির সাথে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। সাম্প্রদায়িকতা কখনো শান্তি আনতে পারে না। এ ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করলে আর এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না বলে আশা করা যায়। যদি কেউ ভেবে থাকে, বৌদ্ধদের ওপর এভাবে অত্যাচার চালানো হলে তারা দেশ থেকে পালিয়ে যাবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। এ দেশ সব সম্প্রদায়ের। বৌদ্ধরা সবার সাথে এক হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে চায়। সরকারের এবং  সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দায়িত্ব সংখ্যালঘুদের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত করা। দোষারোপ না করে আর সান্ত্ব—নার বাণী না শুনিয়ে সব রাজনৈতিক দল এক হয়ে ঘটনার মূল হোতাদের খুঁজে বের করাই দায়িত্ব।  প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি নয়, সরকার যদি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে, তাহলে এর প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে।

No comments:

Post a Comment