৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার ২০১২ খ্রি. ১৯ আশ্বিন ১৪১৯ সাল ১৭ জিলক্বদ ১৪৩৩ হিজরি
ঘটনার ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে তদন্ত দল ।। কক্সবাজারে আতংকাবস্থা এখনও কাটেনি
আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার ॥
এক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী যুবকের ফেসবুকে (সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম) কোরআন অবমাননার জের ধরে শনিবার রাতে রামুতে এবং পরদিন উখিয়া-টেকনাফে বৌদ্ধদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়িতে দুর্বৃত্তদের হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটনার ৪ দিন পরও বৌদ্ধ পল্লীতে আতংক কাটেনি। তবে পরিস্থিতি শান্ত থাকায় উখিয়া ছাড়া অন্যান্যস্থান থেকে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। হামলার ঘটনায় গতকাল অভিযান চালিয়ে পুলিশ আরো ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে। এর আগে মঙ্গলবার পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত ১৬৯ জনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি গতকাল অনুষ্ঠিত হয়নি। ধর্মপ্রতিমন্ত্রী গতকাল রামুর আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং শান্তি সমাবেশ করেছেন। শনি ও রবিবারের ঘটনা তদন্তে গঠিত তদন্ত দল গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে। তদন্ত দল ঘটনার ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে বলে জানা গেছে। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. জসিমউদ্দিন জানান, উখিয়ায় শুক্রবার পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বলবৎ রাখা হবে। অন্যদিকে এসব হামলার ঘটনায় পুলিশের ধরপাকড় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে নিরীহ লোকদের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।তিনি জানিয়েছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। তিনি জানান, হামলার ঘটনায় এরআগে মঙ্গলবার পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত ১৬৯ জনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি গতকাল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। তবে আজ বৃহস্পতিবার ২টি মামলার আসামিদের রিমান্ড আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান তিনি। এদিকে শনি ও রবিবারের ঘটনা তদন্তে গঠিত সরকারী তদন্ত দল গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে। ৪ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত দলের প্রধান ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুল ইসলাম মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারে পৌঁছে গতকাল সকালে আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন বলে জানান ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. জসিমউদ্দিন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা যায়, তদন্ত দল শনিবার রামুর ম্যাসাকারের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে সেই তথ্য এখনই প্রকাশ করা হচ্ছে না। অবশ্য তদন্ত দল কতটুকু প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেন সে আশংকাও প্রকাশ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে। অন্যদিকে হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত গানপাউডারের উৎস সম্পর্কে এখনও কোন তথ্য জানতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ সুপার জানান, এবিষয়ে জেলা পুলিশে কোন বিশেষজ্ঞ নেই। তিনি জানান, আলামত পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের একদল বিশেষজ্ঞ আজ বৃহস্পতিবার কক্সবাজারে আসছেন। এদিকে প্রশাসনের একটি মাত্র সিদ্ধান্তই রামুতান্ডব রুখতে পারত বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। তাদের মতে, কোরআন অবমাননার জের ধরে জনগণের মাঝে বিক্ষোভের সূচনা হলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন অভিযুক্ত যুবককে আটক করে ঘটনার শুরুতেই বিক্ষোভের প্রশমন ঘটাতে পারত। কিন্তু তাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে প্রশাসন পরোক্ষাভাবে সহিংসতা উস্কে দেয়। ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাহায্য চাওয়া হলেও তখন কারো কিছুই করা ছিল না। ঘটনাটি সহিংসতায় রূপ নেওয়ার আগেই প্রশাসন বিজিবি কিংবা সেনাবাহিনীর সহায়তা নিলেও তা রোধ করতে পারত। এক্ষেত্রে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন পর্যাপ্ত সময় পেলেও সময়মত উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া বিক্ষোভ শুরুর ৩ ঘন্টার মধ্যেও যখন উত্তেজনা প্রশমন করা যাচ্ছিল না, তখন প্রশাসনের উচিৎ ছিল ১৪৪ ধারা জারি করা।
সূত্র আরো জানায়, হামলা শুরুর অন্তত ২ ঘন্টা আগে গোয়েন্দারা প্রশাসনকে সতর্ক করলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। রাত সাড়ে ১১টায় গোয়েন্দা সূত্রের খবরে কক্সবাজার ও টেকনাফ বিজিবি এবং রামু ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা সম্ভাব্য সহিংসতা ঠেকাতে প্রস্তুত হয়ে থাকলেও সিভিল প্রশাসন তাদের কোন সাহায্য চায়নি। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে দীর্ঘসূত্রিতা বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে এক নজিরবিহীন ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছে, যা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকদের মনে এক গভীর রেখাপাত করেছে। এর সুদূর প্রসারী প্রভাব নিয়েও সংশ্লিষ্টদের মনে নানা আশংকা বিরাজ করছে।
তবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন,সহিংসতা ঠেকাতে পুলিশের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সবকিছু করা হয়েছিল। কিন্তু রাতের আঁধারে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কিছু দুষ্কৃতকারীর কর্মকাণ্ড ঠেকাতে পুলিশের লোকবল ছিল একেবারেই নগণ্য।
পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগে পুলিশের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন মহলে যোগাযোগ করা হয়েছিল। এছাড়া জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও ঘটনার ব্যাপারে জানানো হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসন ঊর্ধ্বতন মহলের সাথে যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত পেতে বিলম্ব হওয়ায় এরমাঝে ঘটে যায় অঘটন।
No comments:
Post a Comment