Wednesday, 3 October 2012

ইতিমণি, তুমি আমাদের ক্ষমা করো


Prothom Alo

কালের পুরাণ

ইতিমণি, তুমি আমাদের ক্ষমা করো

সোহরাব হাসান | তারিখ: ০৪-১০-২০১২
আক্রান্ত বৌদ্ধপল্লির অনেক বাড়িই এ রকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে
আক্রান্ত বৌদ্ধপল্লির অনেক বাড়িই এ রকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে
অঘটনের দেশ বাংলাদেশ। একটার পর একটা অঘটন ঘটে চলেছে। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া যখন আগামী ডিসেম্বরের পর কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন তখন ভেবেছিলাম, অন্তত দুটি মাস দেশের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারবে। কিন্তু অক্টোবর শুরু না হতেই কক্সবাজার থেকে রাজশাহী—হঠাৎ সারা দেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। রাস্তায় ভাঙচুর শুরু হয়ে গেছে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে সন্ত্রাসীরা কক্সবাজারের রামু উপজেলার বৌদ্ধপল্লিতে সংঘবদ্ধ হামলা চালিয়ে বহু বৌদ্ধমন্দির, বিগ্রহ ও বসতবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে, ভাঙচুর করেছে। কারা হামলাকারী তা নিয়ে রাজনীতি চলছে। এক দল আরেক দলকে দোষারোপ করছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে আক্রান্ত মানুুষগুলোর প্রতি কারও সহমর্মিতা নেই। বরং এ ঘটনা থেকে সরকার ও বিরোধী দল যে যার মতো রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু রামুর, উখিয়ার, টেকনাফের বৌদ্ধপল্লির সেই আক্রান্ত, বিপন্ন মানুষদের সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই। ঘরবাড়ি হারিয়ে তারা কেউ খোলা আকাশের নিচে, কেউ সেনাবাহিনীর তৈরি তাঁবুতে বাস করছে। শনিবারের পর রোববারও হামলার ঘটনা ঘটেছে আমাদের সুদক্ষ ও সু-অভিজ্ঞ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে।
বিএনপি বলেছে, এর পেছনে সরকারের ইন্ধন আছে। সরকার বলেছে, জঙ্গি মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী জড়িত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বৌদ্ধপল্লিতে হামলার ঘটনায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো শৈথিল্য ছিল না। তাঁর এ বক্তব্য আমাদের আরও বেশি ভাবিয়ে তোলে। স্থানীয় প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ হলে আমরা ধরে নিতাম, গুটিকয়েক লোকের কারণে এই অঘটন ঘটেছে। কিন্তু এখন বুঝতে হবে, এই অঘটনের জন্য আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ এবং সমাজে নেতৃত্বদানকারী সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়, সবাই দায়ী। আক্রমণকারীরা ড্রোন থেকে বোমা ফেলেনি যে তাদের প্রতিরোধ করা কঠিন ছিল। তাদের হাতে ছিল লাঠিসোঁটা ও গান পাউডার। প্রতিবেশীরা সংঘবদ্ধ হয়ে এগিয়ে এলে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সময়মতো পদক্ষেপ নিলে এই ধ্বংসযজ্ঞ হতো না।
ঘটনাটি সংখ্যালঘু বৌদ্ধপাড়ায় না হয়ে মুসলিমপাড়ায় হলে কি তা প্রতিহত করার চেষ্টা হতো না? অবশ্যই হতো। বৌদ্ধপাড়ায় হামলা হয়েছে বলে অন্য পাড়ার লোকেরা এগিয়ে আসেননি। ঘরে দরজা দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। আর এখন আমরা পত্রিকায় লিখে, বক্তৃতা দিয়ে, প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি। প্রতিটি দুর্যোগে আমরা সম্মিলিত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি। অতীতের সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার হলে এ রকম ঘটনা ঘটত না।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, দেশ মানচিত্রে থাকে না, থাকে সেখানে বসবাসরত মানুষের হূদয়ে। সেই হূদয় একবার ভেঙে গেলে, রক্তাক্ত হলে জোড়া লাগানো বেশ কঠিন। আমরা বারবার আমাদের সংখ্যালঘুদের হূদয় রক্তাক্ত করেছি, লাঞ্ছিত করেছি। রামুর ঘটনার মধ্য দিয়ে সমাজে সংখ্যাগুরুর প্রতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যে অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরি হলো, তা কীভাবে দূর হবে? যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁরা কি সত্যিকারভাবে সেই অবিশ্বাস ও সন্দেহ দূর করতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেবেন? না সংখ্যালঘুরা বরাবরের মতো ভোটের রাজনীতির হাতিয়ার হবেন?
রাজশাহীর ছাত্র সংঘর্ষ কিংবা ঢাকায় পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষের যে উত্তাপ, তার নিচে হয়তো আক্রান্ত বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কান্না ও দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে যাবে। তাদের আহাজারি হারিয়ে যাবে আমাদের বিভেদাত্মক ও হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির যূপকাষ্ঠে। ভোটের রাজনীতিতে এক পক্ষ আমাদের
উন্নয়নের খোয়াব শোনাবে, আরেক পক্ষ দেশরক্ষার গল্প শোনাবে।
কয়েক দিন আগে সহকর্মী শিশির মোড়ল বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর একটি তথ্যমূলক প্রতিবেদন লিখেছিলেন প্রথম আলোতে। তাতে বলা হয়েছিল, নানা ধরনের নিগ্রহের কারণে দেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমলেও বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের সংখ্যা একই জায়গায় স্থির আছে। খ্রিষ্টানদের বিষয়টি বুঝলাম, নানা মিশনারি সংগঠন সক্রিয়। কিন্তু বৌদ্ধদের সংখ্যা কীভাবে এক জায়গায় স্থির আছে? আছে এ কারণে যে তারা মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, চীন, কিংবা জাপান নয়, বাংলাদেশকেই নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছে। গৌতম বুদ্ধের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আশায় ছিল, এক দিন শান্তি আসবে। জগতের সকল প্রাণী সুখী হবে। কিন্তু রামুর ঘটনা, উখিয়ার ঘটনা সেই আশাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে, এই হামলার পেছনে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হাত থাকতে পারে। কিছুদিন আগে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানের ওপর নৃশংস হামলা হয়েছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমরা সেই হামলাকারীদের ধিক্কার জানাই। বিচারের দাবি করি। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানের ওপর হামলার দায় বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় নেবে কেন?
বৌদ্ধপল্লিতে হামলার পেছনে বা সামনে কারা ছিল, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। আক্রান্ত মানুষগুলো এ নিয়ে রাজনীতি চায় না, তারা চায় সত্য বেরিয়ে আসুক। প্রকৃত অপরাধীরা চিহ্নিত হোক, শাস্তি পাক। তাতে হয়তো এই অসহায় মানুষগুলোর মনে বেঁচে থাকার আশা জাগবে, অতীতের গ্লানি ও যন্ত্রণা ভুলে যেতে পারবে।
১৯৭১ সালে আমরা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও নৃগোষ্ঠীনির্বিশেষে সবার বসবাসের উপযোগী একটি রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। সবার বসবাসের উপযোগী রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান পূর্বশর্ত হলো সব ধর্মের মানুষকে সমদৃষ্টিতে দেখা, কারও প্রতি বৈষম্য না করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই রাষ্ট্র ও সমাজে এমন একটা আবহ তৈরি করা হয়েছে, যাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ত বিপন্ন বোধ করে। যারা রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়ায় ঘৃণ্য হামলার শিকার হয়েছে, তাদের কাছে আমরা ক্ষমা চাইছি; এই রাষ্ট্র, আমাদের প্রশাসন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আমাদের সমাজ তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে। এ আমাদের সম্মিলিত দায়, যুগপৎ ব্যর্থতা। মানুষ কখনো কখনো মানুষের শত্রু বা প্রতিপক্ষ হতে পারে। কিন্তু নিষপ্রাণ বৌদ্ধবিগ্রহগুলো কী অপরাধ করেছে? শত শত বছরের পুরোনো বুদ্ধমূর্তি, বিগ্রহও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। কারা হামলা চালিয়েছে, সেটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, কারা আক্রান্ত হয়েছে। আক্রমণকারীদের আমরা এখনো চিহ্নিত করতে না পারলেও আক্রান্তরা খোলা আকাশের নিচে ভাঙা বৌদ্ধবিগ্রহ ও মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের জলে নিজেদের পরিচয় জানিয়ে দিচ্ছে। একটি সমাজে শত শত বছর একসঙ্গে বাস করেও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় তাদের আপন করে নিতে পারেনি।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এ ইনাম আহমেদ ও জুলফিকার আলী মানিক সরেজমিন প্রতিবেদন করতে গিয়ে ইতিমণি নামে আট বছরের একটি ছোট্ট শিশুর সাক্ষাতের যে মর্মস্পশী বর্ণনা দিলেন, তা যেকোনো মানুষের চোখ ভিজিয়ে দেবে। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। দুই সহকর্মী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আক্রমণের রাতে সে কোথায় ছিল? সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মায়ের আঁচলে মুখ লুকায়। তারপর অনেক কষ্টে সে জানাল, সুপারিবাগানে তারা লুকিয়ে ছিল। পরের প্রশ্ন ছিল, কেন লুকিয়ে ছিলে? শিশুটি জবাব দিল: তারা আসছিল বলে। কারা আসছিল? মেয়েটি নীরব। কারা আসছিল? মেয়েটি এবারও নীরব! তারা কেন আসছিল? মেয়েটি বলল, ‘আমাদের হত্যা করতে!’ কেন তোমাদের হত্যা করতে এসেছিল? কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, ‘আমরা যে বৌদ্ধ।’ এরপর তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কেন তারা হত্যা করবে, তোমরা বৌদ্ধ বলে? মেয়েটি বলল, ‘হ্যাঁ।’ মেয়েটির চুল পরিপাটি ছিল, একদিকে লাল ক্লিপে আঁটা। কিন্তু চোখেমুখে ছিল আতঙ্ক। সারা রাত যে শিশুটি খাবার ও পানি ছাড়া খেতের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, তার কাছে কেউ আশা করে না, সে ভালো থাকবে!
কিন্তু তাকে শেষ প্রশ্ন ছিল, কে তোমাদের হত্যা করতে চেয়েছিল?
‘তারা মুসলমান’—মেয়েটি বলল। [সূত্র: ডেইলি স্টার, ০৩.১০.২০১২]
ইতিমণির মনে হামলাকারীরা যে ভয় ও আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছে, যে অবিশ্বাস ও ঘৃণা তৈরি করেছে, আমাদের এই রাষ্ট্র ও সমাজ কি তা মুছে ফেলতে পারবে? সরকারের আর্থিক সহায়তায় তাদের পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি নির্মাণ করা গেলেও মনের ভাঙা মন্দির জোড়া লাগবে কি?
ইতিমণি, আমরা তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমরা তোমার বাবা-মায়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমরা ক্ষমাপ্রার্থী সেদিন দুর্বৃত্তদের হিংস্র থাবায় যেসব বৌদ্ধ নর-নারী ও শিশু আক্রান্ত হয়েছিল, তাদের সবার কাছে।
সহকর্মী ও কথাশিল্পী মশিউল আলম এখন কক্সবাজারের রামুতে। তিনি গতকাল প্রথম আলোয় আক্রান্ত এলাকার একটি হূদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন, যা প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে ‘কে ওদের অভয় দেবে?’ শিরোনামে। মশিউল আলম লিখেছেন, ‘শহরের প্রায় মধ্যিখানে শ তিনেক পরিবার নিয়ে বৌদ্ধপল্লিটির ভেতরে ঢুকলে নৈঃশব্দ্য যেন আরও গাঢ় হয়ে আসে। নাকে এসে লাগে ছাইয়ের গন্ধ। ...হঠাৎ দরজার কাছ থেকে ভেসে এল নারীকণ্ঠে কান্নার শব্দ। তাকিয়ে দেখি দরজার বাইরে হাঁটু গেড়ে বসে ভেতরের বুদ্ধমূর্তির দিকে জোড়া হাত তুলে কাঁদছেন এক নারী।’
এই কান্না কি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষের কানে কখনো পৌঁছাবে?
অতীতের মতো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর, মানুষের ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হওয়ার পর সরকার আক্রান্তদের অভয় দিচ্ছে, প্রশাসন শান্তির কথা বলছে। এরপর সরকারি নির্দেশে মানববন্ধন ও সম্প্রীতি-সমাবেশ হবে। বিরোধী দল প্রতিবাদ সভা করবে। কিন্তু ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসীরা যে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মনে, সেই ভয় মুছে ফেলার উদ্যোগ কে নেবে? কে দেবে তাদের অভয়? কে বলবে এ দেশ কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের নয়, এ দেশ হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান—সবার।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে দ্রোহী লেখক হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, ‘এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?’ তিনি নিজেও ধর্মান্ধদের হিংসা ও ঘৃণার শিকার হয়ে ক্ষতবিক্ষত শরীরে কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। তারপর আর পারেননি।
আজ তাঁর কথার প্রতিধ্বনি তুলে আমরাও প্রশ্ন করছি, ‘এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?
ইতিমণি, তুমি আমাদের ক্ষমা করো।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments:

Post a Comment