সাম্প্রদায়িকতা
আমাদের নামে নয়, দেশের নামে নয়
ফারুক ওয়াসিফ | তারিখ: ০৫-১০-২০১২
সেই কালরাতে কেবল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঘর-মন্দির আর আস্থাই পোড়েনি, পুড়েছে বাংলাদেশের আত্মাও। কোথায় থাকে দেশের আত্মা? ক্ষমতাভবনে নয়, জাতীয় পতাকায়ও নয়, সেটা থাকে দেশবাসীর হূদয়ে, মানুষে মানুষে সম্পর্কের বুননে। দেশ কোনো বিমূর্ত জিনিস নয়। দেশ মানে দেশবাসীর সংহতি, নাগরিক আত্মীয়তা, প্রতিবেশিতার আস্থা ও বিশ্বাস। এসবই দেশ ও দশের আত্মার প্রাণভোমরা। রামুর আগুনে এই প্রাণভোমরাই দগ্ধ হয়েছে। আর তা করা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মের নামে। বাঙালিত্বের নামেও। তারা কেবল চাকমা বা রাখাইন সমাজকেই নিশানা করেনি, তাদের আসল নিশানায় ছিল বাংলাদেশ এবং তার বহুজন-জাতি-ধর্মের পরিচয়। সবুজ সুপারিবনের পটভূমিতে পোড়া কাঠ-টিনের স্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা পোড়া বুদ্ধপ্রতিমা পোড়া বাংলাদেশের আত্মারই প্রতীক।
এই প্রতীককে দেখিয়েই বিশ্ব মিডিয়ায় খবর রটছে, বাংলাদেশে মুসলিম ভিন্ন অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ অনিরাপদ। মিয়ানমার আর থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাংলাদেশ এবং তার জনগণের বড় অংশকে অভিযুক্ত করে বিক্ষোভ করেছেন। দেশটিকে আফগানিস্তানের সঙ্গে তুলনার প্ররোচনাও অনেকেই সামলাতে পারছেন না। মানুষের প্রাণ না গেলেও জাতীয় ভাবমূর্তির প্রাণ কী নিদারুণভাবেই না আহত হলো! মানবতার কাঠগড়ায় এখন একসঙ্গে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, বাঙালি ও মুসলমান। একাত্তরের অসাম্প্রদায়িক মৈত্রীর বাংলাদেশের ধারণার ওপর এ আঘাত সওয়াও যায় না, কওয়াও যায় না।
কওয়া যায় না, কারণ, ঘটনাটিকে ঠিক সাম্প্রদায়িক সংঘাত বলা যাচ্ছে না। সওয়া যায় না, কারণ, এটা স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক সাম্প্রদায়িক সংঘাত নয়। সাম্প্রদায়িক সংঘাত হলে দুই পক্ষের লড়াই দেখা যেত। অথচ এখানে প্রতিপক্ষ ছিল না, ছিল প্রতিরোধহীন নিরীহ মানুষ। আক্রমণকারীদের প্রতিপক্ষ হওয়ার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের প্রশাসনের। অথচ শান্তির রোম যখন পুড়ছিল, তখন ক্ষমতার নিরোরা রাজনীতির বাঁশি ফুঁকতে ব্যস্ত ছিল। উভয় রাজনৈতিক জোট পরস্পরকে দুষতে যতটা আগ্রহী ছিল, প্রতিকারে ততটা নিষ্ঠা দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেতা পারতেন না অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে? কিন্তু এখনো তাঁরা সেমুখো হননি। তাঁরা যা করতে পারেননি, তা করে দেখিয়েছেন রামু ও উখিয়ার একগুচ্ছ সাধারণ মানুষ। তাঁরাই পুড়ে যাওয়া থেকে অমূল্য এক সম্পদ বাঁচাতে জান বাজি রেখেছিলেন। সেই সম্পদের নাম মানবতা, আরেক নামে যাকে আমরা দেশাত্মা বলছি।
অনেকেই যখন বিমূঢ় ও লজ্জিত বা উদাসীন, তখন রামুর ছয় যুবক, উখিয়ার এক কলেজশিক্ষক কর্তব্য বুঝে নিয়েছিলেন। ডেইলি স্টার পত্রিকা ঠিকই বলেছে, এঁরাই ‘আমাদের সময়ের বীর’। কিন্তু বীর হলেও তাঁরা ট্র্যাজিক। সাহসের কমতি ছিল না, চেষ্টারও ঘাটতি হয়নি। কিন্তু শক্তিতে কুলায়নি। শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী অশক্ত হওয়ায় তাঁদের চেষ্টা ব্যর্থ হলো। সংখ্যায় কম হলেও রামুর বৌদ্ধপল্লির সামনে লাঠি হাতে হামলাবাজদের প্রথম আঘাত তাঁরা ঠেকাতে পেরেছিলেন। কারণ, আক্রমণকারীদের মধ্যে মুখচেনা লোকজন ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় অচেনা লোকেরা দলেবলে আরও ভারী হয়ে এলে তাঁরা ব্যর্থ হন। যদিও ছয়জন থেকে সংখ্যায় তাঁরা বেড়ে হয়েছেন ৩০। সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ততায় এর থেকে বেশি আর কী করা যায়? কিন্তু সম্পূর্ণ সংগঠিত ও প্রস্তুত শত শত দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে ৩০ জনের মানবদেয়াল দাঁড়াতে পারেনি। লাঠি আর ঢিলের আঘাতে তাঁরা ভেঙে পড়েন।
উখিয়া ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক শাহ আলমের কথা: ‘১০ ঘণ্টা পাহারা দিয়ে রাখলাম। একসময় দেখলাম, ওরা দল বেঁধে ধেয়ে আসছে। মনে হচ্ছিল, আর পারব না। মন্দিরের ফটকে আমি ওদের পায়ে ধরি। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না। আমাকে মাড়িয়েই ওরা ভাঙচুর শুরু করে। ওদের পায়ের নিচে চাপা পড়ে আমি জ্ঞান হারাই।’ (৪ অক্টোবর, প্রথম আলো)
বীরেরা চিরকালই ট্র্যাজিক এবং নিঃসঙ্গ। রামুর ৩০ যুবক কিংবা উখিয়ার এক শিক্ষকের মতো লোকেরা সারা দেশেই আছেন। ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গায় এই জঘন্য হামলার বিরুদ্ধে নাগরিকেরা প্রতিবাদেও নেমেছেন। কিন্তু তা যথেষ্ট নয় বলেই ব্যর্থ পুলিশের লোক দিয়েই তদন্ত কমিটি করে দায় খালাস করতে পারছে সরকার। যেখানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বিএনপি, ছাত্রদল এবং জামায়াত-শিবিরের লোকজনের জড়িত, সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কথা। কথা হলো, লেজ গরুকে চালায়, নাকি গরু লেজকে নাড়ায়? রোহিঙ্গাদের পক্ষে রাজনৈতিক দল, পুলিশ ও প্রশাসন, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে স্থানীয় ও বহিরাগতদের ট্রাকে ট্রাকে আনা ও গ্রুপে গ্রুপে লেলিয়ে দেওয়া এবং গান পাউডার, পেট্রল ইত্যাদি সরঞ্জাম সরবরাহ করা কি সম্ভব? মাত্র দুই থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে এতগুলো জায়গায় ধ্বংসযজ্ঞ সমন্বয়ে বড় নেটওয়ার্ক ও তাকদের প্রয়োজন। সেটা কার আছে, সেটাই প্রশ্ন? কার ইঙ্গিতে পুলিশ দর্শক হয়ে রইল, তারও জবাব চাই।
কতিপয় রোহিঙ্গার জন্য সমগ্র রোহিঙ্গা জাতি দোষী হলে, কতিপয় বাঙালি মুসলিমের দোষে তো সমগ্র বাঙালি ও মুসলিম সমাজকেও দুষতে হয়? আমাদের তাই তাকাতে হবে আরও গভীরে। দৃশ্যত সাম্প্রদায়িক মনে হলেও এটা আসলে জাতীয় সংহতির ওপর রাজনৈতিক আক্রমণ। তারা এক ঢিলে সংখ্যাগুরুকে অপরাধী আর সংখ্যালঘুকে বিবাগী করতে চেয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ও সুদূরপ্রসারী। যারা শক থেরাপি দিয়ে ভাবাতে চাইছে যে, বাংলাদেশ কেবল মুসলমানদের দেশ, তারা সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু উভয়েরই দুশমন। রামু বিপর্যয়ে ভিলেনরা যে ধ্বংসের বার্তা বহন করে এনেছে, তার মধ্যে আগামী দিনের বাংলাদেশের বিপদটা পাঠ করা শিখতে হবে। অন্যদিকে তাকাতে হবে কোণঠাসা, আগ্রাসনের তলে পড়া জনগোষ্ঠীর আহত আত্মার গভীরেও।
দেশের সব মানুষ সাম্প্রদায়িক ঘৃণায় অন্ধ হয়ে যেতে পারে না। তা হলেও ইসলাম অবমাননার সাজানো ঘটনার ধুলায় সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে ধোঁকায় ফেলা গেছে। গুজব আর উসকানির ধোঁয়া সরিয়ে বুঝতে সময় লেগেছে মানুষের। তখনই জানা যাচ্ছে, দেশের আত্মা মার খেয়েছে, তবে মরে যায়নি। রামু ও উখিয়ার সাধারণ মানুষের ওই প্রতিরোধ দাবানলে পুড়ে যাওয়া শস্যক্ষেত্রের মাঝে একগুচ্ছ সবুজের আশ্বাস। তা হলেও অনেকেই আসেনি, অনেকেই ভয়ে বা দ্বিধায় জড় হয়ে গিয়েছিল, এটাও মিথ্যা নয়। সেই দ্বিধাবিভক্ত আমাদের কাঁধেই দায় বর্তেছে জানিয়ে দেওয়ার যে, আমাদের নামে আর অনাচার নয়, দেশের গায়ে আর কলঙ্ক নয়।
বনের বাঘকে তাড়ানো সহজ, মনের বাঘই কুরে কুরে খায়। দেশভাগের পরও, অসাম্প্রদায়িক একাত্তরের পরও সাম্প্রদায়িক মনের বাঘ রক্ত খেয়েই চলেছে। অনিঃশেষ দেশভাগ হূদয়েও ফাটল ধরাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতিও তাদের অনুকূলে। মওকা বুঝে সমাজবহির্ভূত শক্তি সেই ফাটলকে খাদ বানাতে কসুর করছে না। এই ফাটল বোজাবার দায়সংখ্যাগরিষ্ঠের। কেবল হামলা-আক্রমণ-বিদ্বেষ থেকে বিরত থাকলেই হবে না, প্রতিবেশী ও সহনাগরিকদের জানিয়ে দিতে হবে: এই অনাচার আমাদের নামে হতে দেওয়া যাবে না, আমাদের দেশের বুকে হতে দেওয়া যাবে না। কথায় ও কাজে, ইমান ও আমলে প্রমাণ করতে হবে, নাম-পরিচয়, সমাজ-সম্প্রদায় আলাদা হতে পারে, কিন্তু আমরা এক দেশের সহবাসী এক রাষ্ট্রের সহনাগরিক। যারা বাংলাদেশকে ভেতর-বাহিরে ডোবাতে চায়, আমাদের নাম-পরিচয়কে আমরা তাদের কাজে ব্যবহূত হতে দিতে পারি না।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দাঙ্গাকারীরা ঘরে ঘরে ঢুকে মুসলমান খুঁজছিল। এ অবস্থায় এক হিন্দু বাড়িতে আশ্রয় পান এক বৃদ্ধ মুসলিম। বাড়ির পুত্রবধূর ঘরে তাঁর আশ্রয় হয়। দাঙ্গাবাজেরা সেখানেও হানা দেয়। লোকটিকে বাঁচাতে তখন বাড়ির মানুষ তাঁকে পুত্রবধূটির চাচা বলে পরিচয় দেয়। লোকটি বেঁচে যায়। এই মানবিক নাটকটি যখন ঘটছে, তখনই জানা গেল বধূটির স্বামী, বাড়ির বড় ছেলেটি নিখোঁজ। পরিস্থিতি শান্ত হলে বৃদ্ধ মানুষটি তাঁর পরিবারে ফিরে যান। তারও অনেক দিন পর জানা গেল, নিখোঁজ ছেলেটি বাবরি মসজিদ ভাঙার দলে ছিল। এই কাহিনির শিক্ষা দুটি: এক. সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে একই পরিবারের সবাই একই আচরণ না-ও করতে পারে। দুই. উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই দাঙ্গার সময় পরস্পরের সহায় হয়।
রামুর পোড়া বুদ্ধমূর্তিগুলো এবং বৌদ্ধ ভাইবোনদের অশ্রুতে তা হলে আমরা কোন সত্য প্রত্যক্ষ করব? এভাবেই কি জাতি, সমাজ, সম্প্রদায় আর ধর্মের মধ্যকার বৈচিত্র্যকে আমরা ফাটলে পরিণত হতে দেব? নাকি সংস্কৃতির ভাঙা সেতু জোড়া লাগাতে মাঠে নামব সেই ট্র্যাজিক বীরদের মতো! হয়তো দেখা যাবে, সেই যুবকদের কারও কারও ভাই মন্দিরে আগুন লাগাতে গিয়েছিল। তখন কি তার পরিবারকেও আমরা ভাগ করব, চাইব দুই ভাইয়ের গৃহযুদ্ধ বাধাতে? দেশ, সমাজ, সম্প্রদায় ভাগের শেষে, এমনকি পরিবার ভাগের শেষে আমরা কি আমাদের মনটাকেও ভাগ করতে বসব? এভাবে ভাঙতে ভাঙতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আমরা? একটাই দেশ, একটাই রাষ্ট্র আর একটাই ভবিষ্যৎ আমাদের। একে আর ভাগ করার সুযোগ নেই। এখন প্রয়োজন বাংলার মুসলিম, বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান আর বাংলার জনজাতি-আদিবাসীরা এক হয়ে স্বদেশটাকে আপন করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার। এভাবে মনপোড়ানো আগুন থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উজ্জীবন নিতে পারব কি আমরা?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
এই প্রতীককে দেখিয়েই বিশ্ব মিডিয়ায় খবর রটছে, বাংলাদেশে মুসলিম ভিন্ন অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ অনিরাপদ। মিয়ানমার আর থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাংলাদেশ এবং তার জনগণের বড় অংশকে অভিযুক্ত করে বিক্ষোভ করেছেন। দেশটিকে আফগানিস্তানের সঙ্গে তুলনার প্ররোচনাও অনেকেই সামলাতে পারছেন না। মানুষের প্রাণ না গেলেও জাতীয় ভাবমূর্তির প্রাণ কী নিদারুণভাবেই না আহত হলো! মানবতার কাঠগড়ায় এখন একসঙ্গে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, বাঙালি ও মুসলমান। একাত্তরের অসাম্প্রদায়িক মৈত্রীর বাংলাদেশের ধারণার ওপর এ আঘাত সওয়াও যায় না, কওয়াও যায় না।
কওয়া যায় না, কারণ, ঘটনাটিকে ঠিক সাম্প্রদায়িক সংঘাত বলা যাচ্ছে না। সওয়া যায় না, কারণ, এটা স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক সাম্প্রদায়িক সংঘাত নয়। সাম্প্রদায়িক সংঘাত হলে দুই পক্ষের লড়াই দেখা যেত। অথচ এখানে প্রতিপক্ষ ছিল না, ছিল প্রতিরোধহীন নিরীহ মানুষ। আক্রমণকারীদের প্রতিপক্ষ হওয়ার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের প্রশাসনের। অথচ শান্তির রোম যখন পুড়ছিল, তখন ক্ষমতার নিরোরা রাজনীতির বাঁশি ফুঁকতে ব্যস্ত ছিল। উভয় রাজনৈতিক জোট পরস্পরকে দুষতে যতটা আগ্রহী ছিল, প্রতিকারে ততটা নিষ্ঠা দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেতা পারতেন না অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে? কিন্তু এখনো তাঁরা সেমুখো হননি। তাঁরা যা করতে পারেননি, তা করে দেখিয়েছেন রামু ও উখিয়ার একগুচ্ছ সাধারণ মানুষ। তাঁরাই পুড়ে যাওয়া থেকে অমূল্য এক সম্পদ বাঁচাতে জান বাজি রেখেছিলেন। সেই সম্পদের নাম মানবতা, আরেক নামে যাকে আমরা দেশাত্মা বলছি।
অনেকেই যখন বিমূঢ় ও লজ্জিত বা উদাসীন, তখন রামুর ছয় যুবক, উখিয়ার এক কলেজশিক্ষক কর্তব্য বুঝে নিয়েছিলেন। ডেইলি স্টার পত্রিকা ঠিকই বলেছে, এঁরাই ‘আমাদের সময়ের বীর’। কিন্তু বীর হলেও তাঁরা ট্র্যাজিক। সাহসের কমতি ছিল না, চেষ্টারও ঘাটতি হয়নি। কিন্তু শক্তিতে কুলায়নি। শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী অশক্ত হওয়ায় তাঁদের চেষ্টা ব্যর্থ হলো। সংখ্যায় কম হলেও রামুর বৌদ্ধপল্লির সামনে লাঠি হাতে হামলাবাজদের প্রথম আঘাত তাঁরা ঠেকাতে পেরেছিলেন। কারণ, আক্রমণকারীদের মধ্যে মুখচেনা লোকজন ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় অচেনা লোকেরা দলেবলে আরও ভারী হয়ে এলে তাঁরা ব্যর্থ হন। যদিও ছয়জন থেকে সংখ্যায় তাঁরা বেড়ে হয়েছেন ৩০। সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ততায় এর থেকে বেশি আর কী করা যায়? কিন্তু সম্পূর্ণ সংগঠিত ও প্রস্তুত শত শত দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে ৩০ জনের মানবদেয়াল দাঁড়াতে পারেনি। লাঠি আর ঢিলের আঘাতে তাঁরা ভেঙে পড়েন।
উখিয়া ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক শাহ আলমের কথা: ‘১০ ঘণ্টা পাহারা দিয়ে রাখলাম। একসময় দেখলাম, ওরা দল বেঁধে ধেয়ে আসছে। মনে হচ্ছিল, আর পারব না। মন্দিরের ফটকে আমি ওদের পায়ে ধরি। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না। আমাকে মাড়িয়েই ওরা ভাঙচুর শুরু করে। ওদের পায়ের নিচে চাপা পড়ে আমি জ্ঞান হারাই।’ (৪ অক্টোবর, প্রথম আলো)
বীরেরা চিরকালই ট্র্যাজিক এবং নিঃসঙ্গ। রামুর ৩০ যুবক কিংবা উখিয়ার এক শিক্ষকের মতো লোকেরা সারা দেশেই আছেন। ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গায় এই জঘন্য হামলার বিরুদ্ধে নাগরিকেরা প্রতিবাদেও নেমেছেন। কিন্তু তা যথেষ্ট নয় বলেই ব্যর্থ পুলিশের লোক দিয়েই তদন্ত কমিটি করে দায় খালাস করতে পারছে সরকার। যেখানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বিএনপি, ছাত্রদল এবং জামায়াত-শিবিরের লোকজনের জড়িত, সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কথা। কথা হলো, লেজ গরুকে চালায়, নাকি গরু লেজকে নাড়ায়? রোহিঙ্গাদের পক্ষে রাজনৈতিক দল, পুলিশ ও প্রশাসন, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে স্থানীয় ও বহিরাগতদের ট্রাকে ট্রাকে আনা ও গ্রুপে গ্রুপে লেলিয়ে দেওয়া এবং গান পাউডার, পেট্রল ইত্যাদি সরঞ্জাম সরবরাহ করা কি সম্ভব? মাত্র দুই থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে এতগুলো জায়গায় ধ্বংসযজ্ঞ সমন্বয়ে বড় নেটওয়ার্ক ও তাকদের প্রয়োজন। সেটা কার আছে, সেটাই প্রশ্ন? কার ইঙ্গিতে পুলিশ দর্শক হয়ে রইল, তারও জবাব চাই।
কতিপয় রোহিঙ্গার জন্য সমগ্র রোহিঙ্গা জাতি দোষী হলে, কতিপয় বাঙালি মুসলিমের দোষে তো সমগ্র বাঙালি ও মুসলিম সমাজকেও দুষতে হয়? আমাদের তাই তাকাতে হবে আরও গভীরে। দৃশ্যত সাম্প্রদায়িক মনে হলেও এটা আসলে জাতীয় সংহতির ওপর রাজনৈতিক আক্রমণ। তারা এক ঢিলে সংখ্যাগুরুকে অপরাধী আর সংখ্যালঘুকে বিবাগী করতে চেয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ও সুদূরপ্রসারী। যারা শক থেরাপি দিয়ে ভাবাতে চাইছে যে, বাংলাদেশ কেবল মুসলমানদের দেশ, তারা সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু উভয়েরই দুশমন। রামু বিপর্যয়ে ভিলেনরা যে ধ্বংসের বার্তা বহন করে এনেছে, তার মধ্যে আগামী দিনের বাংলাদেশের বিপদটা পাঠ করা শিখতে হবে। অন্যদিকে তাকাতে হবে কোণঠাসা, আগ্রাসনের তলে পড়া জনগোষ্ঠীর আহত আত্মার গভীরেও।
দেশের সব মানুষ সাম্প্রদায়িক ঘৃণায় অন্ধ হয়ে যেতে পারে না। তা হলেও ইসলাম অবমাননার সাজানো ঘটনার ধুলায় সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে ধোঁকায় ফেলা গেছে। গুজব আর উসকানির ধোঁয়া সরিয়ে বুঝতে সময় লেগেছে মানুষের। তখনই জানা যাচ্ছে, দেশের আত্মা মার খেয়েছে, তবে মরে যায়নি। রামু ও উখিয়ার সাধারণ মানুষের ওই প্রতিরোধ দাবানলে পুড়ে যাওয়া শস্যক্ষেত্রের মাঝে একগুচ্ছ সবুজের আশ্বাস। তা হলেও অনেকেই আসেনি, অনেকেই ভয়ে বা দ্বিধায় জড় হয়ে গিয়েছিল, এটাও মিথ্যা নয়। সেই দ্বিধাবিভক্ত আমাদের কাঁধেই দায় বর্তেছে জানিয়ে দেওয়ার যে, আমাদের নামে আর অনাচার নয়, দেশের গায়ে আর কলঙ্ক নয়।
বনের বাঘকে তাড়ানো সহজ, মনের বাঘই কুরে কুরে খায়। দেশভাগের পরও, অসাম্প্রদায়িক একাত্তরের পরও সাম্প্রদায়িক মনের বাঘ রক্ত খেয়েই চলেছে। অনিঃশেষ দেশভাগ হূদয়েও ফাটল ধরাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতিও তাদের অনুকূলে। মওকা বুঝে সমাজবহির্ভূত শক্তি সেই ফাটলকে খাদ বানাতে কসুর করছে না। এই ফাটল বোজাবার দায়সংখ্যাগরিষ্ঠের। কেবল হামলা-আক্রমণ-বিদ্বেষ থেকে বিরত থাকলেই হবে না, প্রতিবেশী ও সহনাগরিকদের জানিয়ে দিতে হবে: এই অনাচার আমাদের নামে হতে দেওয়া যাবে না, আমাদের দেশের বুকে হতে দেওয়া যাবে না। কথায় ও কাজে, ইমান ও আমলে প্রমাণ করতে হবে, নাম-পরিচয়, সমাজ-সম্প্রদায় আলাদা হতে পারে, কিন্তু আমরা এক দেশের সহবাসী এক রাষ্ট্রের সহনাগরিক। যারা বাংলাদেশকে ভেতর-বাহিরে ডোবাতে চায়, আমাদের নাম-পরিচয়কে আমরা তাদের কাজে ব্যবহূত হতে দিতে পারি না।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দাঙ্গাকারীরা ঘরে ঘরে ঢুকে মুসলমান খুঁজছিল। এ অবস্থায় এক হিন্দু বাড়িতে আশ্রয় পান এক বৃদ্ধ মুসলিম। বাড়ির পুত্রবধূর ঘরে তাঁর আশ্রয় হয়। দাঙ্গাবাজেরা সেখানেও হানা দেয়। লোকটিকে বাঁচাতে তখন বাড়ির মানুষ তাঁকে পুত্রবধূটির চাচা বলে পরিচয় দেয়। লোকটি বেঁচে যায়। এই মানবিক নাটকটি যখন ঘটছে, তখনই জানা গেল বধূটির স্বামী, বাড়ির বড় ছেলেটি নিখোঁজ। পরিস্থিতি শান্ত হলে বৃদ্ধ মানুষটি তাঁর পরিবারে ফিরে যান। তারও অনেক দিন পর জানা গেল, নিখোঁজ ছেলেটি বাবরি মসজিদ ভাঙার দলে ছিল। এই কাহিনির শিক্ষা দুটি: এক. সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে একই পরিবারের সবাই একই আচরণ না-ও করতে পারে। দুই. উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই দাঙ্গার সময় পরস্পরের সহায় হয়।
রামুর পোড়া বুদ্ধমূর্তিগুলো এবং বৌদ্ধ ভাইবোনদের অশ্রুতে তা হলে আমরা কোন সত্য প্রত্যক্ষ করব? এভাবেই কি জাতি, সমাজ, সম্প্রদায় আর ধর্মের মধ্যকার বৈচিত্র্যকে আমরা ফাটলে পরিণত হতে দেব? নাকি সংস্কৃতির ভাঙা সেতু জোড়া লাগাতে মাঠে নামব সেই ট্র্যাজিক বীরদের মতো! হয়তো দেখা যাবে, সেই যুবকদের কারও কারও ভাই মন্দিরে আগুন লাগাতে গিয়েছিল। তখন কি তার পরিবারকেও আমরা ভাগ করব, চাইব দুই ভাইয়ের গৃহযুদ্ধ বাধাতে? দেশ, সমাজ, সম্প্রদায় ভাগের শেষে, এমনকি পরিবার ভাগের শেষে আমরা কি আমাদের মনটাকেও ভাগ করতে বসব? এভাবে ভাঙতে ভাঙতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আমরা? একটাই দেশ, একটাই রাষ্ট্র আর একটাই ভবিষ্যৎ আমাদের। একে আর ভাগ করার সুযোগ নেই। এখন প্রয়োজন বাংলার মুসলিম, বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান আর বাংলার জনজাতি-আদিবাসীরা এক হয়ে স্বদেশটাকে আপন করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার। এভাবে মনপোড়ানো আগুন থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উজ্জীবন নিতে পারব কি আমরা?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
No comments:
Post a Comment