Wednesday, 3 October 2012

পুলিশের হাতে ভিডিও ফুটেজ



বুধবার | ৩ অক্টোবর ২০১২ | ১৮ আশ্বিন ১৪১৯ | ১৬ জিলকদ ১৪৩৩
পুলিশের হাতে ভিডিও ফুটেজ
সারোয়ার সুমন, কক্সবাজার থেকে
মসজিদের মাইক ব্যবহার করে হামলার জন্য উস্কানি দিয়েছে কারা? মধ্যরাতে কারা আনল গান পাউডার ও স্প্রে মেশিন? বহিরাগতরা কোন এলাকা দিয়ে কীভাবে এলো? স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান ও মেম্বারসহ জনপ্রতিনিধিদের নেপথ্য ভূমিকা কেমন ছিল? ঘটনার পর থেকে সন্দেহভাজনরা কে কোথায় আছে? মিছিল ও সমাবেশের নেতৃত্বে ছিল কারা? এমন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। সেটি ধরে শুরু হয়েছে গ্রেফতার অভিযানও। গতকাল রাতেই রামু, টেকনাফ ও উখিয়া থেকে ৮৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আবার সন্দেভাজন কয়েকজন রাজনীতিবিদকে রেখেছে গোয়েন্দা নজরদারিতে। 
জনরোষ কমাতে গতকাল ক্লোজ করা হয়েছে রামু থানার ওসি একে নজিবুল ইসলামকে। গতকাল সকাল ১০টায় রামু উপজেলা থেকে ১৪৪ ধারাও প্রত্যাহার করে নিয়েছে প্রশাসন। তবে টেকনাফ ও উখিয়ায় এখনও বলবৎ আছে ১৪৪ ধারা। এদিকে 
ঘটনার দু'দিন পর গতকাল ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির পরিদর্শন করতে আসেন স্থানীয় সাংসদ লুৎফর রহমান কাজল। এ সময় ক্ষতিগ্রস্তরা ঘটনার আগে তিনি কেন সক্রিয় ছিলেন না সে বিষয়ে জানতে চান। এমপি কাজল ঘটনার জন্য প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকেই দায়ী করেন। 
মধ্যরাতের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছে কারা
প্রশাসনের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, 'শনিবার মধ্যরাতে কিছু জনপ্রতিনিধির ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। বিক্ষোভ সমাবেশে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত হতে বলে পরে আবার ভাংচুরে নেতৃত্ব দিতে দেখেছি স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধিকে। আমরা তাদের অনেককে নজরদারিতে রেখেছি। আবার মসজিদের মাইক ব্যবহার করে যারা হামলার জন্য মানুষ একত্রিত করেছে তাদেরও শনাক্ত করছি। নিশ্চিত হয়ে গ্রেফতার করা হবে এদের সবাইকে।' ভিডিও ফুটেজ পাওয়ার কথা স্বীকার করে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, 'পাঁচ-ছয়টি বিষয় সামনে রেখে ইন্ধনদাতাদের ধরছি আমরা। ঘটনার সময়কার ভিডিও ফুটেজ ও স্টিল ছবি হাতে আসায় কাজ এখন আগের চেয়ে দ্রুত হবে।'
ছেড়াংঘাটা রাখাইনপাড়ার বাসিন্দা ও জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহসান ভুলু জানান, রাত ১০টার দিকে রামু বাজারে আসা একটি মিছিল থেকে নারায়ে তকবির স্লোগান শোনেন তিনি। ওই মিছিলে হাফেজ ও নুরুল্লা নামক দুই ব্যক্তিকে স্লোগান ধরতে দেখেন তিনি। এ মিছিলে প্রায় ৪০ জন লোক ছিল। 
চৌমুহনী এলাকার এক স্টেশনারি ব্যবসায়ী জানান, মিছিলটির সামনে ছিলেন রামু উপজেলার আওয়ামী মৎসজীবী লীগের সভাপতি আনছারুল হক ভুট্টো। এতে আরও ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন ও যুবলীগ নেতার ভাই হাফেজ মোহাম্মদ। প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, 'মেরংরুয়া গ্রামে মিছিল বের করার আগে মাইকে ঘোষণা দিয়ে মানুষ একত্রিত করা হয়। আর এ কাজটি করেন বিএনপিপন্থি ইউপি মেম্বার কামাল উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন বিএনপির দিদার, জহিরসহ অন্তত ৩০ জন।' ১২টি বৌদ্ধ মন্দিরের মধ্যে ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের এই গ্রামে সর্বোচ্চ ৫টি মন্দির পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। উল্লেখ্য এই ইউনিয়নে নির্বাচিত চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ভুট্টো হচ্ছেন জামায়াতের সমর্থক। আবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪টি মন্দির পোড়ানো হয় জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়নেও বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান। 
চলছে গ্রেফতার অভিযান 
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা ব্যক্তিদের ধরতে অভিযান জোরদার করেরছে পুলিশ। গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত রামু, টেকনাফ ও উখিয়া থেকে মোট ১৬৯ জনকে আটক করেছে পুলিশ। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করা হয় ৮৮ জনকে। এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, 'গতকাল রাতে মোট ৮৮ জনকে আটক করেছি। এর মধ্যে রামু থেকে ২০ জন, উখিয়া থেকে ৩৯ জন ও টেকনাফ থেকে ২৯ জনকে আটক করা হয়। সন্দেভাজনদের ধরতে অভিযান আজও অব্যাহত থাকবে।' 
১৪৪ ধারা প্রত্যাহার
টেকনাফ ও রামুতে ১৪৪ ধারা অব্যাহত থাকলেও গতকাল সকাল ১০টা থেকে রামুর ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করে নেয় প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবী চন্দ বলেন, 'আইন-শৃঙ্খলা মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আসায় আপাতত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে প্রয়োজন মনে করলে আবার এটি জারি করবে প্রশাসন।
ওসি ক্লোজড
রামু উপজেলার বিতর্কিত ওসি একে নজিবুল ইসলামকে গতকাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। তার স্থলে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মোয়াজ্জেম হোসেনকে। তবে গতকাল রাত ৭টা পর্যন্ত নতুন ওসি কর্মস্থলে যোগ দেননি বলে জানান থানার ডিউটি অফিসার আবদুর রহমান। তিনি বলেন, 'ওসি বদল হওয়ার খবর নিশ্চিত হলেও এখন পর্যন্ত দায়িত্ব হস্তান্তর হয়নি।' স্থানীয় জনগণ ওসির অবহেলার কারণে রামুতে এত বড় সহিংস ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করে আসছিল। ঘটনার দিন তাকে ফোন করে ভিক্ষুরা ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করলেও ওসি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো ব্যবস্থা নেননি। স্থানীয় এমপিও ্ওসির নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেন। বিভিন্ন পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ আসায় ওসিকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে ঊর্ধ্বতন প্রশাসন। 
দু'দিন পর ঘটনাস্থলে এলেন এমপি
শনিবার রাতে রামুর ১১টি মন্দির ও ১৫টি বসতঘর দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে দিলেও স্থানীয় এমপি লুৎফর রহমান কাজল ঘটনাস্থলে এসেছেন গতকাল। এ সময় ক্ষতিগ্রস্তরা এমপিকে ঘটনার আগে কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেননি তা জানতে চান। এ সময় বসতঘর পুড়ে যাওয়া তুপান বড়ূয়া এমপিকে জিজ্ঞেস করেন, 'স্যার এতদিন আপনি কোথায় ছিলেন। সেদিন যদি আপনি উদ্যোগ নিতেন তাহলে বাড়িঘর অঙ্গার হতো না আমাদের।' তার কথা শুনে এমপি কাজল বলেন, 'আমি প্রশাসনকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বার বার অনুরোধ করেছি, কিন্তু তারা আমার কথায় কর্ণপাত করেনি।' এমপি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ারও আশ্বাস দেন।
সেনাবাহিনী ও জেলা প্রশাসনের সাহায্য : রামুতে সহিংসতার শিকার বৌদ্ধ পরিবার ও মন্দিরগুলোতে পাঁচ লাখ টাকা ও ২৬ বান্ডিল ঢেউটিন বিতরণ করেছে সেনাবাহিনী। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং প্রতিটি মন্দিরকে ২ বান্ডিল করে ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে জিওসি ২৪ পদাতিক ডিভিশনের পক্ষ থেকে ৫৭ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল যায়েদ হোসেন এসব অর্থ বিতরণ করেন।
এদিকে কক্সবাজার জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। জেলা পরিষদের প্রশাসক মঙ্গলবার বিকেলে এসব টাকা বিতরণ করেন। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ২৪ পরিবারকে ৫ হাজার, প্রতিটি মন্দিরের অধ্যক্ষকে ৫ হাজার এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে বিতরণ করা হয়েছে। এ সময় অন্যদের মধ্যে রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী কানিজ ফাতেমা মোস্তাক, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মুসরাত জাহান মুন্নী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
রামুতে আটকের সংখ্যা বেড়ে ৬০
কক্সবাজারের রামু উপজেলার বৌদ্ধপল্লী ও মন্দিরে সংঘটিত সহিংস ঘটনায় প্রায় দেড় হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে ৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলায় গতকাল আটক হয়েছে আরও ৪১ জন। এ নিয়ে গত দু'দিনে রামুতে আটককৃতের সংখ্যা বেড়ে হলো ৬০ জন। রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবী চন্দ ৬০ জনকে আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

No comments:

Post a Comment