মোশাহিদা সুলতানা ঋতু
বৌদ্ধদের উপর সহিংসতা: শংকা ও বিভ্রান্তির রাজনীতি

সহিংসতা হঠাৎ করে শুরু হয় না | এর পিছনের কারণ অনেকদিন থেকে তৈরি হয় | কোনো একটি সুযোগে তার প্রকাশ ঘটে মাত্র | কিন্তু অনেক বড় সম্ভাবনা থাকে এই ধরনের সহিংসতার ভ্রান্ত ব্যাখ্যা জনপ্রিয় হয়ে উঠবার | যেই সুযোগেই এই সহিংসতার প্রকাশ ঘটুক না কেন, কারা এর জন্য দায়ী তা বের করতে বেশী সময় লাগার কথা নয়| কারণ দুস্কৃতিকারীর সত্যিকার রূপ উন্মোচন করার থেকেও কঠিন সমস্যা হলো অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা | আবার বেশীরভাগ সময় প্রচারের থেকে অপপ্রচারটাও কোনো কোনো শ্রেণির, পেশার, ও রাজনীতিবিদদের জন্য শাপে বর হয়ে যায় | গত সপ্তাহেও হিলারি ক্লিন্টন কোনো প্রমাণ না দেখিয়ে লিবিয়ার আমেরিকান এমব্যাসিতে আক্রমনের জন্য আল কায়দাকে দায়ী করে ফেললেন | আবার এদিকে সিরিয়ার সশস্ত্র আন্দোলনের সাথে আল কায়েদাকে জড়িত প্রমান করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুবিধা হয় সিরিয়াতে প্রবেশ করতে | একইভাবে অনেকে আশংকা করছেন যে এই সহিংসতার সাথে ইসলামিক দলগুলোর সম্পৃক্ততাকে প্রমাণ করতে পারলে এখানে আমেরিকান ঘাটি তৈরিতে সুবিধা হবে, এবং এই সুযোগে আমেরিকান তেল কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশের গ্যাস উত্তোলনের পথ সুগম হবে |
এই সব আশংকার কোনটিই মিথ্যা নয় | মিথ্যা হয়ত নয় যে আসলেই শাসক গোষ্ঠী, ইসলামিক দল, এবং রোহিঙ্গারা সকলেই এর সাথে নানানভাবে যুক্ত | কিন্তু উদ্দেশ্যটি কি শুধুই ধর্মীয় বিদ্বেষ নাকি অন্য কিছু এই ধর্মীয় বিদ্বেষকে উস্কানি দিয়েছে? হয়ত শাসক গোষ্ঠী, ইসলামিক দল, ও রোহিঙ্গারা যার যার গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে সম্মিলিত উদ্যোগে এই ঘটনা ঘটায়নি, হয়ত একটি উগ্রপন্থী ধর্মীয় মনোভাবকে ব্যবহার করে স্বার্থান্নেষী শ্রেণি একীভূত হয়েছে | কিন্তু কোনো ঘটনা ঘটতে দেখে যথার্থ দায়িত্ব পালন না করাও এক অর্থে অপরাধে সামিল হবার মতই |
সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে যে রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়াতে আক্রমনের সময় পুলিশের উপস্থিতি ছিল খুবই নগন্য, বা একেবারেই অনুপস্থিত | এধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে জানা গেছে যে অনেক জায়গায় আক্রমনের আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল এলাকাবাসীকে | কাজেই যেখানে এলাকাবাসী জানত, সেখানে পুলিশ কি ভাবে না জানে তা একটু হাস্যকরই বটে | তাছাড়া, এই অঞ্চলটিতে বাড়তি সতর্কতা থাকার কথা ছিল একারণেই যে এ ধরনের ধর্মীয় সহিংসতার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সংখ্যা লঘুর (রোহিঙ্গা) উপর আক্রমন হলে, এবং বৃহত্তর শক্তির বিরুদ্ধে (বাংলাদেশ বা মিয়ানমার) আন্দোলন ব্যর্থ হলে, অন্য সংখ্যা লঘুর (রাখাইন বা বৌদ্ধ ) উপর আক্রমনের সম্ভাবনা থাকে |
বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যে এ ধরনের সহিংসতার সহজ শিকার হতে পারে তা অনেক আগেই আন্দাজ করার কথা ছিল | পুলিশের জনবল নেই, বা তাদের কাছে তথ্য ছিল না – এই সব নিতান্তই অজুহাত ছাড়া কিছু নয় |
পুলিশ সতর্ক হয়েছে কিন্তু সময় শেষ হওয়ার পর | যখন সতর্ক হয়েছে তখন তারা কাদেরকে গ্রেপ্তার করছে তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ্ | কারণ ইতিমধ্যে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে যে পুলিশ ১৬৬ জনকে আক্রমনকারী সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করেছে | এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মানুষ, বাঙালি, রোহিঙ্গা, এবং শিপইয়ার্ডের শ্রমিক | এদিকে সাংবাদিকদের কাছ থেকে জানা তথ্য অনুযায়ী আক্রমনের শিকার বৌদ্ধ এলাকাবাসী সুনির্দিষ্টভাবে আক্রমনকারীদের পরিচয় জানাতে অস্বীকার করছে কারণ সংখ্যা লঘু হিসাবে হামলাকারীদের এই পরিচয় উন্মোচন করলে তাদের ভবিষ্যতে বিপদগ্রস্ত হবার আশংকা রয়েছে | সহিংসতা শুধু মানুষের বাড়ি ঘর ও জানমাল ধ্বংস করে না, এধরনের সহিংসতার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় মানুষ | যেই ভীতি ও ত্রাস তাদের মনে তৈরি হয়েছে তার জন্য তারা কখনই একটি সংখ্যালঘু হিসাবে নিরাপদ বোধ করবে না নিজের ভিটামাটিতে | জানা গেছে রাত হলেই ওই এলাকাবাসীর মধ্যে ভীতি বাড়তে থাকে |
বৌদ্ধদের উপর এই আক্রমনকে নিয়ে এখন নানান ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হবে | এর মধ্যে নিরপরাধ কিছু রোহিঙ্গা যে গ্রেপ্তার হবে না তা বলা যায় না | ভেবে দেখা দরকার যে যেই স্থানগুলিকে আক্রমনের জন্য বেছে নিয়েছে হামলাকারীরা সেই এলাকাগুলির কাছে মুসলিমদের বসবাস কম, অথবা অন্যদিক থেকে মুসলিম বসবাস করছে এরকম এলাকায় মন্দিরে আক্রমন হয়নি | এখানে বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে যে এতটা পরিকল্পিতভাবে আগে থেকে এলাকা নির্ধারণ করা এককভাবে রোহিঙ্গাদের পক্ষে এই আক্রমন করা সম্ভব কিনা| ইতিমধ্যে পুলিশ যাদেরকে গ্রেপ্তার করেছে তাদের মধ্যে কতজন রোহিঙ্গা তা এখনো জানা যায়নি | তবে সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানা গেছে যে ওই এলাকাগুলিতে এখনো স্থানীয় লোকদের কাছে অপরিচিত মানুষজনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে |৩০ সেপ্টেম্বর কালের কন্ঠে প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি খবর প্রকাশিত হয় জামাতুল আরাকান নামে একটি সংগঠনের; আরাকান রাষ্ট্র গঠনের তত্পরাকে একটি আশংকা হিসাবে হাজির করে | এবং তারপরই এই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমন ইঙ্গিত দেয় যে এইসব আশংকা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একে অপরের পরিপূরক | সব দূরবর্তী সম্ভাবনা কোনো সুনির্দিষ্ট সমীকরণ মেনে চলে না | মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে চেষ্টা না করে এই বাংলাদেশ-মিয়ানমার অঞ্চলে এই ধরনের ত্রাস ও উত্তেজনা তৈরি করে সব চাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই দেশের নিরীহ মানুষ | সরকার এখন কঠোরভাবে আক্রমনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে, উগ্র ধর্মীয় বিভেদ নিরসনে ব্যর্থ হলে, এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে, অচিরেই নানান শংকা আশংকা এবং বিভ্রান্তি বাড়তে থাকবে | বিভ্রান্তির রাজনীতি, এবং মানুষকে বিভ্রান্ত রাখার রাজনীতি নিয়ে খুব বেশী দূর যাওয়া যায় না | এদেশের মানুষও বেশীদিন বিভ্রান্ত থাকবে না | ধর্মীয় বিভেদ ও বিভ্রান্তি কাদের অনুকূলে যায় তা সনাক্ত করতে এদেশের মানুষের বেশী দিন লাগবে না | বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সহিংস আক্রমন লেখা থাকবে | উৎসেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দমনের এই ব্যর্থতার ভার জাতি হিসাবে আমাদের বইতে হবে অনেকদিন |
মোশাহিদা সুলতানা ঋতু : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস ডিপার্টমেন্ট-এর অর্থনীতির প্রভাষক।
No comments:
Post a Comment