বৌদ্ধপল্লিতে হামলা
দুঃখিত, মর্মাহত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ
আবদুল মান্নান | তারিখ: ০৫-১০-২০১২
মধ্যরাতে তস্করদের দেওয়া আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল
গত শনিবার দিবাগত রাত থেকে শুরু করে মঙ্গলবার পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রামের রামু, পটিয়া, উখিয়া ও টেকনাফে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর কিছুসংখ্যক উগ্র সাম্প্রদায়িক উন্মাদ যে ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা চালাল, তা এককথায় যেকোনো বিবেকবান মানুষকে দুঃখিত, মর্মাহত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে আর জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে আমাদের মাথা হেঁট হয়েছে। ঘটনাটি আরও বেদনাদায়ক এ কারণেই, তা ঘটল বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমি বৃহত্তর চট্টগ্রামে, যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ শত শত বছর ধরে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিতে বাস করছে। একাত্তরেও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর এমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। ঘটনার সূত্রপাত একজন বৌদ্ধ যুবক উত্তম বড়ুয়ার সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পবিত্র কোরআনের একটি অবমাননাকর ছবি ট্যাগ করার অভিযোগকে কেন্দ্র করে। যাঁরা ইন্টারনেট ও ফেসবুক সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও রাখেন, তাঁরা জানেন, অ্যাকাউন্টধারীর যেকোনো একজন বন্ধু (দূর দেশেরও হতে পারে) যেকোনো ছবি তাঁর নির্বাচিত বন্ধুদের ট্যাগ করতে পারেন। উত্তম বড়ুয়াকে ছবিটি ট্যাগ করেছিলেন তাঁর কোনো এক ফেসবুক বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের একটি ওয়েবসাইট থেকে। এতে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না। অনেক সময় ফটোশপ সফটওয়্যার ব্যবহার করে যেকোনো ছবি সম্পাদনার মাধ্যমে সম্পূর্ণ চেহারা পাল্টে দিয়ে তা আপলোড করে অন্য দশজনকে ট্যাগ করে দেওয়া যায়। ফটোশপে প্রস্তুতকৃত এমন সব আপত্তিকর ছবি যেকোনো ফেসবুক ব্যবহারকারী নিয়মিত পেয়ে থাকেন। এমন একটি ছবি নিয়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতো একটি নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠীর বসতভিটা এবং অনেকগুলো উপাসনালয়ের ওপর একদল উন্মাদ চড়াও হবে, তাতে অগ্নিসংযোগ করে তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে এবং তা ঘটবে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের অমার্জনীয় গাফিলতির কারণে, তা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। যে কয়েকটি বৌদ্ধ উপাসনালয় তথা বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করা হয়েছে, তার মধ্যে আছে ১৭০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সীমাবিহারও, যা এ অঞ্চলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে চিহ্নিত। ৩০৬ বছরের পুরোনো এই বিহারটি মিয়ানমার থেকে আনা সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি হয়েছিল। সম্পূর্ণটাই মূল্যবান সেগুন কাঠের তৈরি এই বিহারে রক্ষিত ছিল চার শতাধিক বুদ্ধমূর্তি, তালপাতায় লিখিত অসংখ্য পাণ্ডুলিপি ও বহু মূল্যবান ঐতিহাসিক সামগ্রী আর গৌতম বুদ্ধের অস্থি ধাতুসহ আরও বহু দুর্লভ নিদর্শন। এই বিহারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার একাধিকবার। মধ্যরাতের তস্করদের দেওয়া আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
ঠিক এমনিভাবে ১৯৯২ সালে আরেক দল উন্মাদ ভারতের উত্তর প্রদেশে ৪০০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল। তালেবান আফগানিস্তান দখল করে ১৯৯৯ সালে বামিয়ানের হাজার বছরের পুরোনো দুটি বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করার পর সৌদি আরবের সৌদি গেজেট পত্রিকায় একটি মন্তব্য প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘This is not Islam’ (ইহা ইসলাম নয়)। সে সময় আমি হজব্রত পালন করার জন্য পবিত্র মক্কা নগরে অবস্থান করছিলাম। বখতিয়ার খিলজি তাঁর ভারত অভিযানকালে ১১৯৩ সালে প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার আগে প্রথমে তার বিশাল গ্রন্থাগারে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন, যা সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হতে প্রায় তিন মাস সময় লেগেছিল। ইসলাম কখনো অন্য ধর্মের অবমাননা অনুমোদন করে না। সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে এটি ধরে নেওয়া যায়, দক্ষিণ চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করার একটি বড় পরিকল্পনার অংশ। সঙ্গে আছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিষয়টি। ইতিমধ্যে জামায়াত এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তা বানচাল করার জন্য কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কিছুদিন না যেতেই সাতক্ষীরায় একই ঘটনা ঘটেছে। রাঙামাটিতে কলেজে দুজন ছাত্রের মধ্যে কথা-কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে তা মোড় নেয় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতে।
বেশ কিছুদিন ধরে দেশের নানা স্থানে প্রশাসনের সামনে এই যে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, তাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কারণ নেই। প্রশাসন যদি সতর্ক থাকে এবং সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্যে কোনো ঘাটতি না থাকে, তা হলে এমন সব ঘটনা অবশ্যই রোধ করা সম্ভব। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে এটি মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে এ দুটি ক্ষেত্রেই প্রশাসনের সদিচ্ছার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল, যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, ওই দিন প্রশাসন নীরব ছিল না। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এ ঘটনা সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত এবং দুর্বৃত্তরা সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছিল। উত্তম বড়ুয়ার অ্যাকাউন্টে এই ছবি ট্যাগ করাকে কেন্দ্র করে রামুর মতো একটি ছোট উপজেলায় প্রথমে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। রামু এমন কোনো উপজেলা নয় যে এখানে ঘরে ঘরে কম্পিউটার আছে। আপত্তিকর ছবিটি কিছু তরুণ মুঠোফোনে ডাউনলোড করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেয় এবং একে কেন্দ্র করে শনিবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে উন্মাদরা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। রাত ১০টার দিকে রামু শহরে এই দুষ্কৃতকারীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সেই সমাবেশে স্থানীয় সাংসদ বক্তব্য দেন বলে জানা গেছে। এর কিছু পর খণ্ড খণ্ড মিছিল শুরু হয়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাউকে সেখানে পাওয়া যায়নি। তখন থেকে তারা তৎপর হলে ঘটনা আর বেশি দূর অগ্রসর হতো না। রাত ১২টার দিকে বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েক হাজার দুর্বৃত্ত ট্রাক, পিকআপ আর মোটরসাইকেলে করে গান পাউডার আর পেট্রল নিয়ে এসে বিভিন্ন উপাসনালয় ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ শুরু করে। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর এমনতর ঘটনা শুরু হয় একেবারে চট্টগ্রাম শহরের দোরগোড়া পটিয়ায়। সেখানে হিন্দুমন্দিরেও আগুন দেওয়া হয়েছে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে উখিয়া ও টেকনাফে। আগে আমি একাধিক লেখায় বলেছি, প্রশাসন সরকারের পঞ্চম বছরে এসে পরবর্তী সরকারের জন্য কাজ করে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, প্রশাসনের কোনো কোনো অঙ্গ ইতিমধ্যে তাই শুরু করেছে। আর তা যদি না হয়, তা হলে প্রস্তুতি ও সময় নিয়ে কেমন করে রামুর ঘটনাটা ঘটল এবং তা কয়েক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে পটিয়া, উখিয়া ও টেকনাফে বিস্তার লাভ করল?
হঠাৎ করে কারা ঘটাল এমন ভয়াবহ ঘটনা? সম্পূর্ণ সত্য হয়তো একটি বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে বের হয়ে আসবে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ চট্টগ্রামে মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো বেশ শক্তিশালী। তারা তাদের অনেক জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবহার করে বলে বিভিন্ন মহল নিয়মিত অভিযোগ করে আসছে। জাতীয় সংসদে জামায়াতের যে দুজন সংসদ সদস্য আছেন, তাঁরা দুজনই দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত। কক্সবাজার, টেকনাফ চোরাচালানিদের অভয়ারণ্য। এই পথ দিয়ে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে অস্ত্রেরও চোরাচালান হয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা শুধু যে দক্ষিণ চট্টগ্রামে তাদের অপরাধমূলক কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে, তা নয়। তারা ইদানীং চট্টগ্রাম শহরেও তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তার করেছে। রামুর ঘটনায় রোহিঙ্গারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এ অঞ্চলে জামায়াতের সঙ্গে সঙ্গে হিযবুত তাহ্রীরও বেশ তৎপর। অনেকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশ করার অনুমতি দিতে ওকালতি করেন। তাঁরা তা না জেনে করেন অথবা এ কারণেই করেন, যাতে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য এরা ব্যবহূত হোক, তা তাঁরা চান।
রামু, পটিয়া, উখিয়া, টেকনাফ, সাতক্ষীরা, রাঙামাটি বা হাটহাজারীর ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে মারাত্মক ভুল হবে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী বিচারের প্রক্রিয়াকে যারা বানচাল করতে চায়, তারা দেশে ভবিষ্যতে আরও নানা ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। বছর খানেক পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেও দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো কোনো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা, বিশেষ করে পাকিস্তানের আইএসআই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভবিষ্যতে এর ব্যত্যয় হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকার যদি এখন থেকে সচেতন না হয়, তা হলে দেশে আরও নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, ঘটতে পারে রামুর চেয়ে আরও বড় ধরনের ঘটনা। তাই যদি হয়, তা হলে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য ওত পেতে বসে আছে, তাদেরই লাভ। রামুর ঘটনা প্রশাসনের অনেক দুর্বলতা উন্মুক্ত করে দিয়েছে, যার মধ্যে আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যর্থতা উল্লেখযোগ্য একটি। গোয়েন্দা বাহিনী সুষ্ঠুভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করলে রামুর মতো দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
সবশেষে শনিবার ও রোববার বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল, তার জন্য একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আশা করছি, সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করবে এবং দ্রুততম সময়ে এ ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আরও অনেক রামুকাণ্ড অপেক্ষা করছে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ঠিক এমনিভাবে ১৯৯২ সালে আরেক দল উন্মাদ ভারতের উত্তর প্রদেশে ৪০০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল। তালেবান আফগানিস্তান দখল করে ১৯৯৯ সালে বামিয়ানের হাজার বছরের পুরোনো দুটি বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করার পর সৌদি আরবের সৌদি গেজেট পত্রিকায় একটি মন্তব্য প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘This is not Islam’ (ইহা ইসলাম নয়)। সে সময় আমি হজব্রত পালন করার জন্য পবিত্র মক্কা নগরে অবস্থান করছিলাম। বখতিয়ার খিলজি তাঁর ভারত অভিযানকালে ১১৯৩ সালে প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার আগে প্রথমে তার বিশাল গ্রন্থাগারে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন, যা সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হতে প্রায় তিন মাস সময় লেগেছিল। ইসলাম কখনো অন্য ধর্মের অবমাননা অনুমোদন করে না। সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে এটি ধরে নেওয়া যায়, দক্ষিণ চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করার একটি বড় পরিকল্পনার অংশ। সঙ্গে আছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিষয়টি। ইতিমধ্যে জামায়াত এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তা বানচাল করার জন্য কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কিছুদিন না যেতেই সাতক্ষীরায় একই ঘটনা ঘটেছে। রাঙামাটিতে কলেজে দুজন ছাত্রের মধ্যে কথা-কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে তা মোড় নেয় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতে।
বেশ কিছুদিন ধরে দেশের নানা স্থানে প্রশাসনের সামনে এই যে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, তাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কারণ নেই। প্রশাসন যদি সতর্ক থাকে এবং সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্যে কোনো ঘাটতি না থাকে, তা হলে এমন সব ঘটনা অবশ্যই রোধ করা সম্ভব। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে এটি মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে এ দুটি ক্ষেত্রেই প্রশাসনের সদিচ্ছার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল, যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, ওই দিন প্রশাসন নীরব ছিল না। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এ ঘটনা সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত এবং দুর্বৃত্তরা সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছিল। উত্তম বড়ুয়ার অ্যাকাউন্টে এই ছবি ট্যাগ করাকে কেন্দ্র করে রামুর মতো একটি ছোট উপজেলায় প্রথমে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। রামু এমন কোনো উপজেলা নয় যে এখানে ঘরে ঘরে কম্পিউটার আছে। আপত্তিকর ছবিটি কিছু তরুণ মুঠোফোনে ডাউনলোড করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেয় এবং একে কেন্দ্র করে শনিবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে উন্মাদরা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। রাত ১০টার দিকে রামু শহরে এই দুষ্কৃতকারীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সেই সমাবেশে স্থানীয় সাংসদ বক্তব্য দেন বলে জানা গেছে। এর কিছু পর খণ্ড খণ্ড মিছিল শুরু হয়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাউকে সেখানে পাওয়া যায়নি। তখন থেকে তারা তৎপর হলে ঘটনা আর বেশি দূর অগ্রসর হতো না। রাত ১২টার দিকে বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েক হাজার দুর্বৃত্ত ট্রাক, পিকআপ আর মোটরসাইকেলে করে গান পাউডার আর পেট্রল নিয়ে এসে বিভিন্ন উপাসনালয় ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ শুরু করে। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর এমনতর ঘটনা শুরু হয় একেবারে চট্টগ্রাম শহরের দোরগোড়া পটিয়ায়। সেখানে হিন্দুমন্দিরেও আগুন দেওয়া হয়েছে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে উখিয়া ও টেকনাফে। আগে আমি একাধিক লেখায় বলেছি, প্রশাসন সরকারের পঞ্চম বছরে এসে পরবর্তী সরকারের জন্য কাজ করে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, প্রশাসনের কোনো কোনো অঙ্গ ইতিমধ্যে তাই শুরু করেছে। আর তা যদি না হয়, তা হলে প্রস্তুতি ও সময় নিয়ে কেমন করে রামুর ঘটনাটা ঘটল এবং তা কয়েক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে পটিয়া, উখিয়া ও টেকনাফে বিস্তার লাভ করল?
হঠাৎ করে কারা ঘটাল এমন ভয়াবহ ঘটনা? সম্পূর্ণ সত্য হয়তো একটি বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে বের হয়ে আসবে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ চট্টগ্রামে মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো বেশ শক্তিশালী। তারা তাদের অনেক জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবহার করে বলে বিভিন্ন মহল নিয়মিত অভিযোগ করে আসছে। জাতীয় সংসদে জামায়াতের যে দুজন সংসদ সদস্য আছেন, তাঁরা দুজনই দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত। কক্সবাজার, টেকনাফ চোরাচালানিদের অভয়ারণ্য। এই পথ দিয়ে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে অস্ত্রেরও চোরাচালান হয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা শুধু যে দক্ষিণ চট্টগ্রামে তাদের অপরাধমূলক কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে, তা নয়। তারা ইদানীং চট্টগ্রাম শহরেও তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তার করেছে। রামুর ঘটনায় রোহিঙ্গারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এ অঞ্চলে জামায়াতের সঙ্গে সঙ্গে হিযবুত তাহ্রীরও বেশ তৎপর। অনেকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশ করার অনুমতি দিতে ওকালতি করেন। তাঁরা তা না জেনে করেন অথবা এ কারণেই করেন, যাতে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য এরা ব্যবহূত হোক, তা তাঁরা চান।
রামু, পটিয়া, উখিয়া, টেকনাফ, সাতক্ষীরা, রাঙামাটি বা হাটহাজারীর ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে মারাত্মক ভুল হবে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী বিচারের প্রক্রিয়াকে যারা বানচাল করতে চায়, তারা দেশে ভবিষ্যতে আরও নানা ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। বছর খানেক পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেও দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো কোনো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা, বিশেষ করে পাকিস্তানের আইএসআই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভবিষ্যতে এর ব্যত্যয় হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকার যদি এখন থেকে সচেতন না হয়, তা হলে দেশে আরও নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, ঘটতে পারে রামুর চেয়ে আরও বড় ধরনের ঘটনা। তাই যদি হয়, তা হলে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য ওত পেতে বসে আছে, তাদেরই লাভ। রামুর ঘটনা প্রশাসনের অনেক দুর্বলতা উন্মুক্ত করে দিয়েছে, যার মধ্যে আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যর্থতা উল্লেখযোগ্য একটি। গোয়েন্দা বাহিনী সুষ্ঠুভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করলে রামুর মতো দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
সবশেষে শনিবার ও রোববার বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল, তার জন্য একজন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আশা করছি, সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করবে এবং দ্রুততম সময়ে এ ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আরও অনেক রামুকাণ্ড অপেক্ষা করছে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments:
Post a Comment